ঢাকা: বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর সমরিতা হাসপাতালে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (আ ক ম যাকারিয়া) যখন শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তখন তার বয়স ৯৭ বছর।
কিন্তু ‘ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি’র অভিভাবক হিসেবে এবং এ কমিটির সম্পাদনা মণ্ডলীর সভাপতি ও আরবী-ফারসি ভাষার প্রধান অনুবাদক হিসেবে জীবনের সায়াহ্নে এসে যে ভূমিকা তিনি পালন করেছেন-তা অনেক তরুণ গবেষকের তারুণ্যেভরা বয়সকেও হার মানিয়েছে।
সেই ২০০৮ সাল থেকে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ‘ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি’র সম্পাদনা মণ্ডলীর সবচেয়ে বেশি মিটিংয়ে ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি, অসুস্থ শরীরেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পরিদর্শনের ক্ষেত্রে ৩৫শে পা রাখা অনেক তরুণ মাঠকর্মীর চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনি।
তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়- আ ক ম যাকারিয়াদের মত কর্মবীর বয়সের ফ্রেমে আটকা পড়েন না। বরং তাঁদের কর্মযজ্ঞের শক্ত ফ্রেমে বয়স বন্দি থাকে অনন্তকাল।
‘ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি’র চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক যেমন বললেন, আ ক ম যাকারিয়া পরিণত বয়সেই চলে গেলেন। তবুও তাঁর এ চলে যাওয়াকে অকালপ্রয়াণই বলতে হবে। কারণ উনাদের মত মানুষের প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না।
‘ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি’র একজন অভিভাবক হিসেবে আ ক ম যাকারিয়া যেভাবে কাজটা এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করেছেন, তা অনেক তরুণের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হল, তা পূরণ হবার নয় বলে মনে করেন আরেফিন সিদ্দিক।
‘ঢাকার স্থাপত্য গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি’র মাঠকর্মী সাংবাদিক তরুণ সরকারের মতে, সম্পাদনা মণ্ডলীর সভাপতি ও আরবী-ফারসি ভাষার প্রধান অনুবাদক হিসেবে ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণনয়নের ক্ষেত্রে যে অবদান আ ক ম যাকারিয়া রেখে গেলেন-তা কেবল বাঙালি জাতি নয়, সারা পৃথিবীতে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করা মানুষের জন্য রত্নভাণ্ডার হিসেবে বিবেচিত হবে। কষ্ট শুধু এই যে, কাজটা শেষ করেও শেষটা দেখে যেতে পারলেন না তিনি। আর কিছু দিন বেঁচে থাকলে হয়তো, শিলালিপি গ্রন্থের প্রথম খণ্ড দেখে যেতে পারতেন।
আ ক ম যাকারিয়া সারা জীবন প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে যে কাজ করেছেন, তার ফিরিস্তি নতুন করে লেখার প্রয়োজন নেই। একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়েও ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় তার অবদান অনন্য-অসাধারণ।
এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো তরুণ শিক্ষক বা নবীন গবেষক প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে গেলে আ ক ম যাকারিয়া রচিত গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’, ‘বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি’, ‘Archaeological Heritage of Bangladesh’ র দ্বারস্ত হতে হয়।
গবেষণা ও কর্মজীবনে শতভাগ সাফল্য অর্জনের আগেও ছিল তার আরেক সাফল্য; সেটি তার ছাত্র জীবনে। একাধিক ডিস্টিংশনসহ প্রথম বিভাগ পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন আ ক ম যাকারিয়া।
১৯৪১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে প্রথম বিভাগ ও ঢাকা বিভাগ থেকে মেধাতালিকায় একাদশ স্থান অধিকার করেন।
এরপর ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও ১৯৪৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৪৮ সালে যুক্তরাস্ট্রের লস অঞ্জেলসের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ডিপ্লোমা ইন পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনে উচ্চতর ডিগ্রি নেন তিনি।
অসম্ভব মেধাবী আ ক ম যাকারিয়া কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯৪৬ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু হয় তাঁর। এ পেশায় থাকলে হয়তো আরো বেশি কিছু দিতে পারতেন জাতিকে। এ নিয়ে পরবর্তী জীবনে আক্ষেপও করেছেন গুণি এ মানুষটি।
দেশ বিভাগের আগে একজন কলেজ শিক্ষকের বেতন ছিল ১৫০ টাকা। একজন সরকারি আমলার বেতন তখন ২৫০ টাকা। তাই সৎ ও সচ্ছল জীবনযাপনের আশায় শিক্ষকতা ছেড়ে দেন আ ক ম যাকারিয়া।
১৯৪৬-৪৭ সালে অনুষ্ঠিত অবিভক্ত বাংলার শেষ বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অতিরিক্ত ডেপুটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন তিনি।
এর পর সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও পদাধিকার বলে উপসচিব, জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম-সচিব, শিক্ষা সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং এই পদ থেকেই ১৯৭৬ সালে অবসরে যান আ ক ম যাকারিয়া।
তবে সরকারি চাকরি করলেও প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় প্রগাঢ় প্রেম, প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং অমানবিক পরিশ্রমের স্প্রিহা তাকে প্রত্নতত্ত্বের গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। সারাদিন সরকারি অফিসে দায়িত্বপালন শেষে রাতভর প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস ও ভিন দেশি ভাষা, বিশেষ করে ফারসি, আরবী ও উর্দু ভাষার ঐতিহাসিক বইগুলো পড়তেন।
১৯৪৬ সালের প্রথম দিকে তিনি যখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রভাষক, তখন একদল ছাত্র মহাস্থানগড়ে যায়। জ্ঞান তাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ তখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল।
প্রত্নতত্বে বিশেষ আগ্রহ থাকায় আ ক ম যাকারিয়াকে ছাত্রদের সঙ্গে মহাস্থানগড়ে পাঠান ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। সেখানে গিয়ে প্রত্নসম্পদের রত্নভাণ্ডার দেখ অভিভূত হন তিনি।
সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর ১৯৫৮ সালে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সম্পর্কে পড়াশোনা করতে আ ক ম যাকারিয়াকে পাঠানো হয় সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স শেষে দেড় মাস ছুটি নেন তিনি। এই দেড় মাস গ্রিস, রোম ও মিসরের পিরামিডসহ ইউরোপ ও আমেরিকার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো চষে বেড়ান।
পরে ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমন্দির দেখে আসেন। তখন থেকেই নোট রাখা শুরু করেন তিনি। লেখা শুরু ১৯৭৬ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর।
রেভিনিউ হেড হিসেবে দিনাজপুরে দায়িত্বপালনকালে যেসব গ্রামে রেভিনিউ কালেকশনে যেতে হত তাকে, সেসব গ্রামে ছিল পাল, গুপ্ত ও সেন আমলের প্রাচীন কীর্তি। এ সবের মধ্যে তিনি অসাধারণ প্রত্নসম্পদের সন্ধান পান। কিন্তু দুই বছর পর তাকে ময়মনসিংহ বদলি করা।
পরে ১৯৬৮ সালে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে ফের দিনাজপুরে পোস্টিং দেওয়া হয় তাকে। এবার সেখানে একটি বাঁধানো মাউন্ড (ঢিবি) পান তিনি। তার পূর্বসূরি ওয়েস্ট মে কট ওটাকে বাঁধানো পুকুর বলেছিলেন।
কিন্তু যাকারিয়া বললেন, এটি কোনো মতেই বাঁধানো পুকুর হতে পারে না। তিনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে খনন করার কথা বললেন। সরকারকে বুঝিয়ে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ পেলেন খনন করার জন্য। তখন সেখান থেকে একটি ইমারত বের হল। এটিই পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতকের সীতাকোট বিহার। বাংলার প্রাচীনতম বৌদ্ধবিহার।
শুধু প্রত্নতত্ত্ব চর্চা নয়, অনুবাদ সাহিত্যে অপরিসীম অবদান রয়েছে আ ক ম যাকারিয়ার। প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়তে পড়তে এক সময় মিনহাজ-ই-সিরাজের তবাকত-ই নাসিরি সম্পর্কে জানতে পারেন। ফরাসি ভাষায় লেখা এই বই পরে বাংলায় অনুবাদ করেন।
পুঁথিসাহিত্য নিয়েও কাজ করেছেন তিনি। তাঁর হাতেই রচিত হয়, ‘বাংলা সাহিত্যে গাজী কালু ও চম্পাবতী উপাখ্যান’ এবং ‘গুপিচন্দ্রের সন্যাস’ এর মতো কালজয়ী পুঁথি সাহিত্য।
এছাড়া ‘নবাব সিরজ-উদ-দৌলা’, ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি’, ‘কুমিল্লা জেলার ইতিহাস’, ‘বরেন্দ্র জেলার ইতিহাস’, ‘তারিখ-ই-বংগাল-ই-মহাব্বতজঙ্গী‘, ‘মোযাফফর নামা’, ‘নওবাহার-ই-মুর্শিদকুলী খান’, ‘সিয়ার-উল-মুতাখ-খিরিন’, ‘গ্রাম বাংলার হাসির গল্প, ‘মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার ও একটি তরুনী’ গ্রন্থের জন্য বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের কাছে অমর হয়ে থাকবেন আ ক ম যাকারিয়া।
একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন সব গুণে গুনান্বিত এই মানুষটি। ষাটের দশকে বিজিপ্রেসের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায়, বিজিপ্রেস ১ম বিভাগ ফুটবল টিমের সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম-সচিব এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব, পরে সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশ অন্তত ২১টি ক্রীড়া ফেডারেশন গঠন করেন আ ক ম যাকারিয়া।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন আ ক ম যাকারিয়া। বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবেও দশ বছরের অধিক সময় দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আ ক ম যাকারিয়া সারাজীবন কাজ করেছেন। কিন্তু পদক ও পুরস্কারের পেছনে ছোটেননি কখনো। বরং পুরস্কারই তার পেছনে ছুটেছে।
বই পড়া আর গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে নিজের বাসার ছাদে নিজ হাতে বাগানও করেছিলেন আ ক ম যাকারিয়া। সেই বাগানে ফলাতেন আমলকি, কামরাঙা, লেবু আরো কতো কি!
২০০৫ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০১০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি’র রাষ্ট্রপ্রতির পুরস্কার, Felicitation Volume in honor of Mr. A.K.M. Zakariah by Oxford University, ২০১২ ইতিহাস একাডেমির স্বর্ণপদক, ২০১৫ সালে একুশে পদক ও বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি স্বর্ণপদক, ২০১৬ আমিন জুয়েলার্স স্বর্ণপদকসহ অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৬
এজেড/
** আ ক ম যাকারিয়ার মৃত্যুতে ঢাবি উপাচার্যের শোক
** জানাজা শেষে হিমঘরে আ ক ম যাকারিয়ার মরদেহ
** আ ক ম যাকারিয়ার মৃত্যুতে বিএসপিএ’র শোক