ঢাকা: কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটব্যুরোর সদস্য ও বাম ফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গ শাখার চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস, শৌর্যবীর্য ও কাঠামো বাইরে থেকে কেউ তৈরি করে দেয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষই তাদের পথ বেছে নেওয়ার জন্য এই আন্দোলন-সংগ্রামে নেমেছিলেন।
শনিবার (৫ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের বামপন্থীদের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এই সভার আয়োজন করে।
বিমান বসু বলেন, বিভিন্ন ভাষ্যকারের লেখা, বাংলা, হিন্দি সাময়িকীতে আমি পড়েছিলাম, একটা অদ্ভুত ব্যাপার। সেই লেখাগুলো আমার মনে নাড়া দেয়, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নাকি বাইরে থেকে সংগঠিত হয়ে গেলো! এটা বললে ইতিহাসের বিকৃতি হবে।
পৃথিবীতে যতগুলো মুক্তি সংগ্রাম হয়েছে, কোনো মুক্তি সংগ্রামই বাইরে থেকে হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়ন সাহায্য করেছে, কিন্তু ভিয়েতনামের মানুষ সংগ্রাম না করলে, তারা জীবন না দিলে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় সম্ভবপর হতো না।
‘ঠিক সেই রকম, বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। সংগ্রামের এই আকুতি ও বাসনা মানুষের মনে এসেছে অনেক আগে থেকে। ১৯৫২ সালে পূর্ববাংলার ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, এই ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল, এরপর সেই সলতে জ্বালানোর কাজটা শুরু হয় ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের মানুষের ওপর অত্যাচার, বঞ্চনা, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, দমন-পীড়নের কারণে মানুষ তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও জেহাদ ঘোষণা করে। যুদ্ধের পরিণতি গড়ে উঠা মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। ’
এ বামপন্থী নেতা বলেন, এ দেশের ইতিহাসের যে গৌরব গাঁথা, তা পৃথিবীর কেউ খাটো করে দেখতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে একটি প্রশ্নযুক্ত, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিস ইউনিয়া, তিনি একটি বই লিখলেন, আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমরা নাকি সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছি। পরে যিনি বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, তিনি যদি আরও আগে তার অবস্থান পরিবর্তন করতেন, তাহলে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হতো।
বিমান বসু আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ বামপন্থীরা ভারতে দাবি জানালো, বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিতে হবে, সব ধরনের সাহায্য দিতে হবে বলে প্রচারণা চালাতে থাকে। তখন ইন্দিরা গান্ধী যুক্তি তুললেন কাকে স্বীকৃতি দিবো, সরকার কোথায়? কাকে অস্ত্র দেবো, সেদিন যদি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামকে সঠিকভাবে দেখতে পারতেন এবং বামপন্থীদের দাবি মেনে নিতেন, তাহলে কোটি শরণার্থীকে ভারতে যেতে হতো না, সাড়ে ছয় কোটি মানুষ যে সংগ্রাম করেছে এবং তাদের মধ্যে যে ১০ লাখ শহীদ হয়েছেন, এই ঘটনাও ঘটতো না।
‘বাংলাদেশের মানুষকে অর্থ সাহায্য দিতে ভারতে ২১ সদস্যের ‘বাংলাদেশ সংহতি ও সাহায্য কমিটি’ গঠিত হয়েছিল, এর একজন সদস্য ছিলাম আমি। ওই সময় যে অর্থ সংগ্রহ হয়েছিল, আগে-পরে এতো অর্থ আর কোনো ক্ষেত্রে সংগৃহীত হয়নি। ‘পিপল রিলিফ কমিটি’ বাংলাদেশের মানুষ, যোদ্ধা ও শরণার্থীদের চিকিৎসায় যে অবদান রেখেছিল তা অতুলনীয়। মেডিকেল সংগঠনগুলো চিকিৎসা দিয়ে গেছে। ছোট ছোট ক্যাম্পের মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে গেছে। ’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারতে সামগ্রিক যে মনোভাব গড়ে উঠেছিল, তা যেন না থাকে, সেজন্য দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়ার পক্ষ থেকে চক্রান্তের জাল বিস্তারিত হয়েছিল। বিশেষ করে সামাজ্র্যবাদী শক্তি এখন মানুষের মধ্যে কীভাবে বিভাজন তৈরি করা যায়, সে চেষ্টা করছে তারা।
বাংলাদেশে বর্ণ, জাতি ভিত্তিতে বিভাজন প্রকট নয়, হয়তো ইস্যুই নয় মন্তব্য করে বামপন্থী এ নেতা বলেন, ভারতে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষার ভিত্তিতে বিভাজন প্রকট। যে শক্তি ভারতের জনগণের মধ্যে বিরোধ-বিভেদ তৈরিতে আপ্রাণ ব্যস্ত রয়েছে, সেই শক্তি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস, বিভাজন ও বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা শত্রুকে পানি দিয়ে বাঁচিয়ে তুলে তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তা ব্যাহত করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ যে শান্তির পথে চলছে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে লড়াই করছে, সেই লড়াইয়ের মধ্যে ফাটল তৈরি করার চেষ্টা হয়তোবা দেখা দিতে পারে।
বিমান বসু বলেন, ‘ভারতের বাপমন্থীদের মধ্যে ঐক্যে তৈরি করতে পেরেছি, সেটা আমরা বলবো না, আগামী দিনে মুক্ত বাংলাদেশকে রক্ষা করা, উন্নত করা, মানুষকে শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্ত করা, নতুন লড়াই সংগ্রামে বামপন্থীদের এক থাকার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। ’
সভায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এবং আয়োজক সংগঠনের সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে যেসব বিতর্ক হয়, সেই বিতর্কগুলোর অধিকাংশ অপ্রাসঙ্গিক ও পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল, তার আহ্বানে মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, এই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বামপন্থীরা যে অবদান রেখেছিলেন, তা আলোচনায় আসে না। সরকারের একটি উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার, তা হল মুক্তিযদ্ধে বাইরের যারা আমাদের সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছিলেন তাদের সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেও ভারতের বামপন্থীদের সম্পর্কে উল্লেখ দায়সারাভাবে করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেও ভারতের বামপন্থীদের সহযোগিতার বিষয়টি নেই।
রাশেদ খান মেনন বলেন, ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলার মানুষ মুক্তিসংগ্রামে আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। কিন্তু মুক্তিকামী মানুষ প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না, কীভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বেন। সে সময়ে ভারতের বামপন্থীরা তাদের সরকারের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। বিশেষ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অবদান অনেক, তাদের সহযোগিতার ভিত্তিতে আমরা মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম।
তিনি বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রথম যে সহায়তা, বামপন্থীদের আন্দোলনের কারণে আগরতলা সীমান্ত পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়েছিল। মার্কিন সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ভারতের বামপন্থীরা শক্ত আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি মেনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার সঞ্চালনায় সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বামপন্থীদের সহযোগিতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দাশ।
বাংলাদেশ সময়: ২২৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৬
টিএইচ/এইচএ/