ঢাকা: সাত বছরে অনেক বদলেছে কষ্টে ঘেরা পিলখানা। আধুনিকতার ছোঁয়া সর্বত্র, বাড়িগুলোতে রং হয়েছে।
২০০৯ সালে ঘটে যাওয়া ‘পিলখানা ট্রাজেডি’ সামনে রেখে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলানিউজ এসব কথা বলেন তিনি।
সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘যাই না এখন আর পিলখানার দিকে। গেলেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। সেদিকটায় আধুনিকায়ন হয়েছে অনেক। বাড়িগুলোতে রং করা হয়েছে। কিন্তু সে রং করা বাড়িগুলো দেখে পুরনো কথা মনে পড়ে, এখনো প্রিয় সহকর্মী-ছাত্রদের রক্তের প্রলেপই দেখি আমি। ’
সেদিন সেনা সদরে কর্তব্যরত ছিলেন ওয়ালীউল্লাহ। ঘটনায় বিস্মিত হয়ে পড়েছিলেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ রাইফেলস সপ্তাহের দরবার চলছিল। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় থাকার কথা যে স্থানটিতে সে সময়, সেখানেই এমন ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন তিনি। এরপর একের পর এক খবরে কেবল কষ্ট বেড়েছে, একের পর এক মানসিক ধাক্কা।
‘পৃথিবীর ইতিহাসে কোন যুদ্ধেও একদিনে একসঙ্গে ৫৭ সামরিক কর্মকর্তা শহীদ হওয়ার নজির নেই। পাঁচ হাজার ৯২৬ জওয়ানের সাজার ঘটনাও ইতিহাস থেকে কখনো মুছবে না। এটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে’- বলেন তিনি।
কর্মকর্তাদের অতিমাত্রার আত্মবিশ্বাস ক্ষতিকর হয়েছে বলে মত তার। বলেন, ‘জওয়ানদের অসন্তোষের আঁচ আগেই পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কর্মকর্তাদের ওভার কনফিডেন্স ক্ষতি করেছে’।
‘অবশ্য কেউ ভাবেনি এমন কিছু হতে পারে। আমরা যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম সেসব জওয়ানদের, আমরা জানি, তারা পরিশ্রমী ও বিনয়ী ছিল। অনুগত ছিল। তারা এমনটি করতে পারে ভাবা যায়নি’- বলেন এ সেনা শিক্ষক।
সামরিক বাহিনীতে শিক্ষকতা করেছেন তিনি দীর্ঘসময়। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষক, পাবনা ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন।
২৮ বছর ধরে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জড়িত এ কর্মকর্তা ১৯৭৯ সালের ৬ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনা শিক্ষা কোরে কমিশন পান। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা পরিদপ্তর, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর, সেনাসদরের স্টাফ অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন।
সেনা কর্মকর্তা ওয়ালীউল্লাহ বলেন, নিরাপত্তার বিঘ্নতায় এমন ঘটনা ঘটতে পেরেছিল, অসাবধানতায় এমন দুর্যোগ নেমে এসেছিল। তখন সবেমাত্র একটি গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নিয়েছে। চলছিল ভাষার মাস। এমন সময়টিতে এমন শোকাবহ ঘটনা মেনে নেয়া যায় না।
বিচারের মাধ্যমে ঘটনাটি সমাধানের চেষ্টা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, সমাধানের পথ নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। সংক্ষুব্ধ ও সংশ্লিষ্টদের সবার ইচ্ছা পূরণ হবে- এমন আশা হয়তো বাঞ্ছনীয় নয়।
আবারও বিডিআর-এর প্রশংসা তার মুখে, ‘এটি ছিলো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতা পদক পেয়েছে, মুক্তিযুদ্ধেও অনেক অবদান। সেসব কারণে তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত ছিল। কিন্তু তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো হতাশ হয়ে পড়েছিল, যা পরে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেনা কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছে, এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তারা ভাবেননি। ’
এ ঘটনা কখনোই মুছে যাবে না, এমন কিছুর পুনরাবৃত্তিও যেন কোথাও না হয়, সেজন্য তার পরামর্শও রযেছে। ওয়ালীউল্লাহ বলেন, ‘যে কোন প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যে কোন ঝুঁকি এড়াতে হবে। কোন পক্ষ যেন অসহায় বোধ না করে। ’
‘বাহিনীর সুশৃঙ্খলতা, নিরাপত্তা, দায়িত্বরতদের মধ্যে শৃঙ্খলা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, চেইন অব কমান্ড মেনে চলা, নিরাপত্তা বলয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া খুবই প্রয়োজন। যে কোন অসন্তোষ বাড়তে দেওয়া উচিৎ নয়। ‘ যোগ করেন তিনি।
ওয়ালীউল্লাহ আবারও বিডিআর সৈনিকদের দেশপ্রেমের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘তাদের দেশপ্রেম নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্ত সে সময়টিতে তাদের একটি অংশে অসন্তোষ ছিল, এক্সপ্লয়টেড ছিল কিছুটা, এছাড়া অবসরে যাওয়া কিছু মানুষের প্রভাবে পড়ে ঘোলাটে হয়েছিল পরিস্থিতি। ’
সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত ছিল বলে মনে করেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা।
বলেন, ‘এ ঘটনায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় যে সদস্যরা প্রথম নিরাপত্তা দেয়, তারা দেশের অভ্যন্তরে এমন কাণ্ড করেছে, যা রাতারাতি হয়নি। ছোট ছোট ভুল নজরে না আনাতেই এত বড় অঘটন ঘটেছে বলে মত লে. কর্নেল ওয়ালীউল্লাহর (অব)।
আলাপের শেষের দিকে জানালেন, তার কষ্টটা দু’দিকেই। সামরিক বাহিনীর সহকর্মীদের স্বজনদের জন্য কষ্ট, তাদের এমন পরিণতি তাকে আঘাত করেছে।
সেই সঙ্গে আঘাত পেয়েছেন বিডিআর জওয়ান ও তাদের স্বজনদের জন্যও। তার চোখে সে সময়ের দৃশ্য ভাসে। শিশুরা স্কুলে যেত একই রকম পোশাক পরে।
মনে হাহাকার আসে। এক ঘটনায় তাদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পিতা বা স্বজনের অপরাধের শাস্তি পাচ্ছে তাদের পরিবারও।
বাংলাদেশ সময়: ০১৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৬
এসকেএস/আরআই