সিরাজগঞ্জ: আব্বা আর চাচা ট্রলার থ্যাইহ্যা ধ্যাক্কা দিয়া নামাইয়া দিয়া কলো- তুই হাতরাইয়া (সাঁতার কেটে) যাইয়া কিছু একটা ধর। আমরা আইসত্যাছি।
ভাঙ্গা গলায় কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলছিল নারায়ণগঞ্জে ধলেশ্বরী নদীতে ডুবে যাওয়া মাটিবাহী ট্রলারের যাত্রী এবং নিহত নেজাব আলীর ষোল বছর বয়সী ছেলে কবির হোসেন।
পাশে বসেই ছেলের শোকে বিলাপ করছিলেন দু’সন্তানের মৃতদেহ কাঁধে নেওয়া নেজাব আলী ও সুজাব আলীর বাবা মন্তাজ আলী। তিনি বলছিলেন, ‘আল্লা আমি কি পাপ হরছিলাম-তুমি আমার দুই মানিক একসাথে কাইড়ি নিয়্যা গ্যালা। বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন নেজাব আলী-সুজাব আলীর মা মেহেরুন বেগম। কথা বলতে গেলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। শান্তনা দেয়ার ভাষা নেই প্রতিবেশীদের।
দু’ভাইকে এক সঙ্গে হারিয়ে বড় বোন মর্জিনা, ছোট বোন রোজিনা ও রুবিয়ার কান্নাও কেউ থামাতে পারছিল না। হৃদয় বিদারক এসব দৃশ্য দেখে প্রতিবেশীসহ আশ-পাশের গ্রাম থেকে দেখতে আসা নারী-পুরুষ তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
একই ট্রলারে কাজ করে বেঁচে ফিরে আসা ভগ্নিপতি শফিকুল ইসলাম, দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে পারছিলেন না। বুক চাপড়িয়ে তিনি বলছিলেন, আল্লাহ আমগোরে উপর ক্যামুন গজব দিলরে..। শোকে পাথর হয়ে গেছেন নেজাব আলীর স্ত্রী কদবানু খাতুন ও সুজাবের স্ত্রী আনজিয়া বেগম।
বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরের দিকে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত চলনবিলাঞ্চলের গ্রাম গারেশ্বরে নিহত ওই শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা যায় শোকের মাতম।
বুধবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে নারয়ানগঞ্জ আলীরটেক ইউনিয়নের গোগনগর এলাকায় ধলেশ্বরী নদীতে ট্রলারডুবিতে ৬ শ্রমিক মারা যান। এদের মধে চারজনের বাড়ি উপজেলার গারেশ্বর গ্রামে এবং তারা একই পরিবারের সদস্য। এরা হলেন, মন্তাজ আলীর ছেলে নেজাব আলী (৩৮) ও সুজাব আলী (৩২), তাদের মামাতো ভাই আজিজল হকের ছেলে শাহীন (২৮) এবং খালাতো ভাই শহিদুল ইসলামের ছেলে শরিফুল ইসলাম (১৮)।
ওই ঘটনায় নিহতর অপর দু’জন হলেন, একই উপজেলার বানিয়াকৈড় গ্রামের সিদ্দিকের ছেলে সুজন (৩০) এবং ফাজিলনগর গ্রামের চয়েনদির ছেলে আবু তালেব (৩০)। বৃহস্পতিবার সকালে গারেশ্বর গ্রামে এক পরিবারের ৪টি মৃতদেহ আনার পর থেকেই স্বজন ও এলাকাবাসীর মাঝে কান্নার রোল নেমে যায়।
নেজাব আলীদের বাড়ির পাশেই নিহত শরীফুল ইসলামের বাড়ি। একমাত্র ছেলের খাটিয়ার কাছ থেকে বাবা শহীদুলকে কেউ সরাতে পারছিল না। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই মুর্ছা যান তিনি। তারপরও খাটিয়ার পাশে বসেই কাঁদছেন অঝোর নয়নে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় শরীফুলের মা সালেকা খাতুন।
শরীফুলের বাড়ির ৫০ গজ দুরে অপর নিহত শাহীনের বাড়ি। তিনিও বাবা-মার একটি মাত্র ছেলে। একই অবস্থা ছিল ওই পরিবারেও।
ট্রলার থেকে বেঁচে ফিরে আসা প্রত্যক্ষদর্শী রবিউল করিম বাংলানিউজকে জানান, ট্রলারটির উপরে ছিলাম। আর ১৫মিনিট এলে আমাদের ট্রলারটি ইটভাটার কাছে এসে পড়ে। হঠাৎ আকাশে মেঘ জমলো। তারপর বৃষ্টি। এরই মধ্যে জাহাজের মত বালু বোঝাই বড় একটি বাল্কহেড এসে আমাদের ট্রলারটিকে তলিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি লাফিয়ে ট্রলার থেকে নেমে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলাম। ইতিমধ্যে আরেকটি বালুর বাল্কহেড এসে আমাদের তুলে নিয়ে চলে গেল।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অবহেলিত ও অনুন্নত এ এলাকার হতদরিদ্র মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রলারে মাটি কাটার কাজ করতে যান। মাসের পর মাস রোদ-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তারা ট্রলারে মাটি ভরাট করে বিভিন্ন ইটভাটায় ওইসব মাটি সরবরাহ করেন। এতে তারা পারিশ্রমিক হিসেবে দিন ৪শ’ থেকে ৪৫০ টাকা করে পান। ইতিপূর্বে ট্রলারে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই নিখোঁজ হয়েছে। ২০১৪ সালে পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার সমাজ গ্রামের ১৬জন শ্রমিক ট্রলারডুবিতে মারা যান। এলাকায় কাজ না থাকায় একটি দালাল চক্রের প্রলোভনে পরে এসব মানুষ নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাটিকাটা শ্রমিকের কাজ করে আসছেন।
ব্যবসায়ী শামীম রেজা বাংলানিউজকে জানান, গারেশ্বর গ্রামের রোনা ফকিরের ছেলে দালাল হেলাল উদ্দিন, জহুরুল ইসলাম, ফরজ আলী, পার্শ্ববর্তী ভাঙ্গুড়া উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের দালাল কালু, সাইফুল, হামিদুল, আব্দুল করিম, আলীসহ অনেকেই এসব শ্রমিকদের টাকার লোভ দেখিয়ে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাচ্ছে।
উধুনিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ বাংলানিউজকে বলেন, একই পরিবারের ৪ জনের মৃত্যুতে এ গ্রামের মানুষ শোকাহত হয়ে পড়েছে। এ মৌসুমে কোনো কাজ না থাকায় হতদরিদ্র এসব মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ট্রলারে কাজ করতে যায়। নিহত ৪জনের প্রত্যেকেই ভূমিহীন দিনমজুর। এসব পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা মারা যাওয়ায় পরিবারগুলো অসহায় অবস্থার মধ্য পড়লো।
উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সন্দ্বীপ কুমার সরকার বাংলানিউজকে বলেন, ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রতি পরিবারকে ২০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এসব পরিবারের জন্য সহযোগীতার ব্যবস্থা করা হবে। কাজ না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যাবার বিষয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে এ এলাকায় জনসচেতনতামূলক সভা করে মানুষকে ওইসব কাজে যাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৬
এসএইচ/