ঢাকা: মাদকের বিস্তার, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, যানজট নিরসন ও নাগরিক জীবনমানের টেকসই উন্নয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
আর এ কাজগুলো করতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজকে সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে এবং সিটি করপোরেশনকে আরও দায়িত্বশীল ও উদ্যোগী হতে হবে।
রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় গুলশান ক্লাবে এক মতবিনিময় সভায় ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক এসব কথা বলেন।
বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও অর্জন ধরে রাখার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পুলিশ বিভাগের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
ফুটপাত দখলমুক্ত করা নিয়ে মেয়র আনিসুল হক বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে ফুটপাতের এক ইঞ্চি জায়গা কারো দখলে থাকবে না। ঢাকা উত্তরের কিছু কিছু এলাকার ফুটপাত ইতিমধ্যে দখলমুক্ত হয়েছে। আশা করি পর্যায়ক্রমে সমস্ত এলাকার রাস্তা, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পারবো।
ইভটিজিং, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রোধে উত্তরের বিভিন্ন পয়েন্ট ক্লোজড সার্কিড (সিসি) ক্যামেরার আওতায় আনা হবে উল্লেখ করে মেয়র বলেন, আমরা গুলশান-বনানী এলাকা থেকে এ কাজটি শুরু করতে চাই। এরইমধ্যে সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। এ সিটি করপোরেশনের আওতাভূক্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে আড়াই হাজার শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা হিসেবে আগামী মে মাসের মধ্যে এক হাজার থেকে ১২শ ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি।
একটি নির্দিষ্ট কন্ট্রোল রুম থেকে এগুলো পর্যবেক্ষণ করা হলে নগরে অপরাধ ৮০ শতাংশ কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
দুর্বিসহ যানজট নিরসন ও পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে আনিসুল হক বলেন, রাজধানীতে আধুনিক টিকেটিং পদ্ধতির তিন হাজার নতুন বাস নামানো হবে। আগামী দু’বছরে পর্যায়ক্রমে তিন হাজার বাস নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এ ছাড়া ঢাকা শহরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য পাঁচ হাজার ডাস্টবিন, শহরের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য পরিবেশ পুলিশ গঠনের কথাও ভাবছে ডিএনসিসি।
আনিসুল হক বলেন, রাজধানীর মানুষের যাতায়াত সমস্যা সমাধানের জন্য ২০১৭ সালের মার্চের মধ্যে তিন হাজার পাবলিক বাস চালু করা হবে। এ অনুয়ায়ী কাজও চলছে। ইতিমধ্যে বাস মালিক সমিতির সঙ্গে কথা হয়েছে। বর্তমানে থাকা ১৯৫টি বাস কোম্পানিকে পাঁচটি কোম্পানিতে নামিয়ে আনার বিষয়ে ডিএনসিসির সঙ্গে মালিকেরা একমত হয়েছেন। এতে রাস্তায় বাসের চলাচলের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা কমে যাবে। পুরোনো বাস তুলে নেওয়া হবে। এ ছাড়া এলাকাভিত্তিক যানজট কমানোর বিষয়েও কাজ করছে করপোরেশন।
মেয়র বলেন, পরিচ্ছন্ন ঢাকার অংশ হিসেবে ঢাকা থেকে ২০ হাজার বিলবোর্ড অপসারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিলবোর্ড স্থাপনের বিষয়ে তিন মাসের মধ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
আনিসুল হক বলেন, পরিচ্ছন্ন ঢাকার আওতায় ঠিকমতো বাতি জ্বালানো ও রাস্তা পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করা হচ্ছে। রাস্তার ওপর যেন ময়লার কনটেইনার পড়ে না থাকে, সে জন্য ৭২টি স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার ডাস্টবিন তৈরি করার কাজ চলছে। যার মধ্যে ২ হাজার ডাস্টবিন আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে তৈরি করা হবে।
রাতের বেলা যাতে ডাস্টবিন চুরি না হয়, সেজন্য বিশেষ ডাস্টবিন তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া একশ গণশৌচাগার তৈরির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে ১৪টি তৈরি হয়ে গেছে। সেই শৌচাগারগুলো পাঁচ তারকা হোটেল মানের মতো হচ্ছে।
তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর এলাকায় মাদক ব্যবসা বেড়ে গেছে উল্লেখ করে মেয়র বলেন, এতে আমাদের যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা কিছু করতে পারছি না।
তিনি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণসহ নগরীর উন্নয়নে পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় জনগণকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধান নিবার্চন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা।
তিনি বলেন, উন্নয়ন কিংবা উন্নতি কেবল একটি বিষয়ের নির্ভর করে না। রাজধানীকে যানজট, মাদকমুক্ত করতে হলে সার্বিকভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে। আমাদের জনগণকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার আগে তাদের মাদকের গ্রাস থেকে রক্ষা করতে হবে। বাসযোগ্য পরিবেশ তাদের জন্য তৈরি করতে হবে। তবেই উন্নয়ন ঘটবে।
মতবিনিময় সভায় অংশ নেন ৬ জন উপ-পুলিশ কমিশনার, ঢাকা উত্তরের ৩৬টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), ৩৬টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলররা।
মতবিনিময় সভায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১০ নং ওয়ার্ডের (সংরক্ষিত) মহিলা কাউন্সিলর শামীমা রহমান, ১৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান, ২০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাছির আলোচনায় অংশ নেন।
পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে প্রথমে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্ত (ওসি) মাযহারুল ইসলাম, বাড্ডা থানার এমএ জলীল, বনানী থানার সালাহউদ্দিন খান ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার ট্রাফিকের সহকারী কমিশনার আবু ইউসুফ আলোচনায় অংশ নেন।
আলোচনার এক পর্যায়ের বিশেষ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কর্মকর্তরা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেন।
জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা আঁতাত করে ব্যবসা করে। পুলিশের অভিযোগ মাদক ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের খুব কাছের ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। ফলে মাদক ব্যবসায়ীরা হাতেনাতে ধরা পড়লেও অনেক সময় তাদের ছেড়ে দিতে হয় অথবা জামিনে মুক্ত হয়ে আবার একই কাজ শুরু করে।
তেজগাঁও এলাকার উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, পুলিশ হলো সমাজের সফ্ট টার্গেট। পুলিশকে যা ইচ্ছা বলা যায়। কিন্তু পুলিশ বলতে শুরু করলে অনেক কিছু বলতে পারে। তবে পুলিশ আইনের বাইরে কিছু বলতে চায় না।
এসময় মেয়রের কাছে তিনি প্রশ্ন রাখেন, উচ্ছেদ করার ফুটপাতে হকার কারা বসায়? কারা অনুরোধ করে হকার উচ্ছেদ না করার জন্য? মাদক বলেন, হকার বলেন, ফুটপাত দখল বলেন এসব সমাধানের দায়িত্ব নিতে রাজনীতিবিদদের।
গুলশান এলাকার ডিসি মোস্তাক আহমেদ বলেন, এই মুহূর্তে পুলিশ প্রশাসন জঙ্গী ও সন্ত্রাস দমনকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ সব সময়ই সোচ্চার। কিন্তু মাদক বাড়ছে। একে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথমে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের জন্য নিরাময় কেন্দ্র বা পুনর্বাসন কেন্দ্র করতে হবে। ফুটপাত দখলকারী হকারদের বেলায়ও তাই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে আইন প্রয়োগ করতে গেলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। তাছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণে শুধু পুলিশের উপর নির্ভর করে চলবে না। এটি সামাজিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
ঢাকা উত্তরের ডিসি (ট্রাফিক) প্রবীর কুমার রায় বলেন, ট্রাফিক পুলিশের কাজ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা। যানজট নিরসন করার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের না। অথচ বর্ষায় রাস্তা ডুবে গেলেও ট্রাফিক পুলিশকে গালি শুনতে হয়।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, রাস্তা দিন দিন কমছে আর গাড়ি বাড়ছে। তাহলে যানজট নিরসন হবে কিভাবে?
ইমতিয়াজ আহমেদ (ডিসি ট্রাফিক) বলেন, কাগজে-কলমে ঢাকা শহরে সাড়ে ৭ শতাংশ রাস্তা থাকলেও যান চলাচলের জন্য সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ রাস্তা ব্যবহার হয়। আবার সারা বছর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি তো আছেই। তাছাড়া গত বছর নতুন করে ৯৫ হাজার ৭৪৩টি যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। এ বছর আরও বেশি দেওয়া হবে। তাহলে যানজট নিরসন কিভাবে সম্ভব?
মতবিনিময় সভায় সবশেষে বক্তব্য দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাউল ইসলাম।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬
এমএইচপি/এসএইচ