ঢাকা: ‘আমাদের দেশে ওয়ার্ক এথিকস ভালো নয়। যদি আপনি ঘাড়ের ওপর বসে না থাকেন, তাহলে কাজ করবে না।
এমন মন্তব্য বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আবু সুফিয়ান হায়দারের। বাংলাদেশে একটা সফল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বিভিন্ন প্রতিকূলতার প্রসঙ্গে এ মন্তব্য করেন।
কাজ কেন ঠিকমত করে না এ বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে সুফিয়ান বলেন, ‘বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারে দেখবেন, কাজের লোকই সব করে। এমনকি মশারি টানানো থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসা পর্যন্ত। এভাবে বড় হলে হঠাৎ করে আপনি একদিন কর্মঠ মানুষ হয়ে উঠবেন না। সবকিছুর ট্রেনিং লাগে’।
‘আমাদের ছোটবেলাই আমাদেরকে পঙ্গু করে দেয়। বিদেশে ছেলে-মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকে নিজের কাজ নিজে করতে উৎসাহিত করা হয়’।
আমেরিকায় গড়ে তোলা alpha.net.bd এর ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশে আসেন আবু সুফিয়ান। সুধীজন নিয়ে মিলনমেলার আয়োজন করেন রাজধানীর একটি হোটেলে।
এ সময় তার সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।
ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে ইলেক্ট্রনিক্স বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান বগুড়ায় জন্ম নেওয়া আলফানেটের এই জনক।
আমেরিকার ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে গড়ে তোলা এ কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির হোস্টিং সার্ভিস দেওয়া। গত ১৫ বছরে অনেক অন্তরায় সত্ত্বেও হাল না ছেড়ে ধীরে ধীরে সফলতায় নিয়ে আসেন আলফানেটকে।
আলফানেটের পাশাপাশি গত ১৩ বছর ধরে একজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ প্রধান হিসাবে কাজ করছেন আমেরিকার shopme.com নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও ফ্লোরিডাতে বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত তিনি। মসজিদ, কবরস্থান স্থাপনসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে সব সময় এগিয়ে থাকেন আবু সুফিয়ান হায়দার।
এসবের পাশাপাশি মার্শাল আর্টেও আবু সুফিয়ান দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত। ২০০৬ সালে আমেরিকার অরল্যান্ডোতে রাইজিং সান মার্শাল আর্টস (rising-sun-dojo.com) নামের একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। গত ১০ বছর ধরে এখানে প্রধান প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করে আসছেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই খুঁটিনাটি বিষয়ে তার আগ্রহ অনেক। স্কুল শেষে শিখতেন জুতা সেলাই, বই বাঁধানো, ছবির ফ্রেম বানানো, বিভিন্ন কারুশিল্প এমনকি বুনতে পারতেন মাছ ধরার জালও।
বগুড়া জিলা স্কুলে পড়ার সময় যোগ দেন বিজ্ঞান মেলায়। বিভিন্ন নতুন নতুন উদ্ভাবনী করে দু’বার রাষ্ট্রপতির হাত থকে জাতীয় পদক অর্জন করেন তিনি। সময়টা নব্বই দশকের। তিন বন্ধু মিলে প্রতি বছরই বিজ্ঞান মেলায় নতুন কিছু নিয়ে আসতেন। সেই বন্ধুদের সঙ্গে ইলেক্ট্রনিক্স বিষয়ে ১৯৯৫ সালে ভারতে পড়তে যাওয়া সুফিয়ানের।
ভারতে যাওয়ার বিষয়ে আবু সুফিয়ান বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ইলেক্ট্রনিক্সে পড়ার জন্য দেশে অনেক চেষ্টা করলাম। অবশেষে না পেরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হই। ভর্তির পর একদিন ক্লাস করে বন্ধুর কাছে শুনলাম, ভারতের মাদ্রাজে ইলেক্ট্রনিক্স বিষয়ে ভালো কলেজ আছে। বাসায় বলার পর ১১দিনের মাথায় ভিসা পাসপোর্ট নিয়ে বেনাপোল দিয়ে ভারত চলে যাই’।
‘মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেঙ্গালুরুর কাছে একটি কলেজে তিন বছরে অনার্স সম্পন্ন করি। এরপর ভারতী দর্শন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করি’।
যেভাবে আমেরিকা যাওয়া
আবু সুফিয়ান বলেন, ‘ভারতে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেও জড়িত ছিলাম। আর মনে হলো, ভালো কিছু করতে হলে আমেরিকা যেতে হবে। বন্ধুদের বলতাম, পড়াশোনা শেষে এক বছরের মধ্যে আমেরিকা যাবো। এবং যাওয়ার এক বছরের মধ্যে একটি কোম্পানি খুলবো। কোম্পানির মাধ্যমে আমেরিকা বাংলাদেশের মধ্যে একটি কানেকশন তৈরি করবো। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশের জন্য কিভাবে কাজ করা যায় সেটা করবো’।
‘কিন্তু আমেরিকা যেতে হলে কি করতে হয় সেটা চিন্তায় ছিলো না। ২০০০ সালে মাস্টার্স শেষ হলো। এর মধ্যে মাইক্রোসফট সল্যুশন ডেভেলপার সার্টিফিকেশন নেই। সঙ্গে অ্যাপটেকের একটি ডিপ্লোমা করি’।
তিনি বলেন, ‘মাস্টার্সের শেষের দিকে বেঙ্গালুরুর একটি সাইবার ক্যাফেতে বসা ছিলাম। এ সময় আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ওহাইয়ো থেকে একটি ই-মেইল এলো। আমি যদি আমেরিকায় পড়তে চাই, তাহলে আবেদন করতে বললো। ওই সময় আমি ভিস্যুয়াল বেসিকে কাজ করি। তারা বললো, কম্পিউটারের কোনো একটি বিষয়ের ওপর পরীক্ষা নিবে। যদি ভালো করি, তাহলে মাস্টার্সে স্কলারশিপ দেবে’।
‘হাতে আর কোনো কাজ না থাকায় আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দেই। ভিস্যুয়াল বেসিকের ওপর পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ভিসার জন্য আবেদন করলাম। সেই সময় (২০০১ সাল) আমেরিকার আইটি ইন্ডাস্ট্রি ক্র্যাশ করলো। তখন ওহাইয়ো’র ওই বিশ্ববিদ্যালয় বললো, এক সেমিস্টার পরে আসতে। তখন ফ্লোরিডায় আমার একজন কাজিন ছিলেন, তার সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি বললেন, ভিসা যেহেতু হয়েছে, চলে আসো। তখন ওহাইয়োতে না গিয়ে ফ্লোরিডায় চলে গেলাম। আমেরিকায় যাওয়ার পরে কাজিন বললেন, যেহেতু মাস্টার্স করা আছে সেহেতু চাকরির জন্য আবেদন করো। তখন ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে স্থায়ী হয়ে গেলাম’।
আলফা নেটের শুরু
আবু সুফিয়ান বলেন, ‘অরল্যান্ডোতে চাকরির পাশাপাশি ২০০১ সালের শেষের দিকে আলফানেট প্রতিষ্ঠা করি। আমেরিকায় কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তির ওপর চাকরি বেশি। আমি ইলেক্ট্রনিক্স পড়াশোনা করেছি, কিন্তু প্রফেশনালি নেটওয়ার্কিং, গ্রাফিকস ডিজাইন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলাম।
চাকরির পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে নিজের কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে গেলাম’।
‘দুই বছর পর shopme.com এর প্রধান প্রোগ্রামার হিসেবে যোগদান করি। আমেরিকা থেকে বসে বাংলাদেশে কাজ করা কঠিন। কয়েক বছর চেষ্টার পর এক বন্ধুর মাধ্যমে সময়নেটের (সময় প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী) ফরিদ আহমেদকে পাই। তিনি বাংলাদেশে আলফানেটের অফিস পরিচালনার দায়িত্ব নেন। বর্তমানে দু’টি ডাটা সেন্টার ব্যবহার করছে আলফানেট (ডালাস ও অরল্যান্ডোতে)।
Domain, Hosting, Web Design, Virtual Server, Dedicated Server আলফানেটের বিশেষত্ব’।
‘আমেরিকায় আমরা ৫ জন বাঙালি বন্ধু আলফানেটের কাজে বিভিন্নভাবে জড়িত। সবাই আমেরিকাতে স্থায়ী। আমরা পাশাপাশি থাকি’।
আলফানেটের ভবিষ্যৎ
তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় আমাদের বড় কিছু প্রজেক্ট আছে। এর মাধ্যমে দেশে ডাটা এন্ট্রিসহ বিভিন্ন পদে কর্মসংস্থান বাড়াবো। এখন ২০ জনের মতো কাজ করছেন। খুব শিগগিরই ৫০ জনের ওপরে যাওয়ার আশা করছি’।
আবু সুফিয়ান জানান, আলফানেটের লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে ব্যাংক, হোটেল, হাসপাতাল, মসজিদ, স্কুল, কলেজের ডাটাবেস সম্বলিত ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করা। যাতে এসব বিষয়ে জনগণ সব তথ্য এক জায়গায় পেতে পারে। ডিজিটালি সবকিছু উন্নত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে ডিজিটাল সেবার ক্ষেত্রে আমাদের তেমন একটা অগ্রগতি নেই। এজন্য মোবাইলঅ্যাপ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সব হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, হোটেল, ঐতিহাসিক স্থাপনা, চেইনসপ, ব্যাংক যেন পেয়ে যাই- এ ধরনের ওয়েবসাইট চালু করবো।
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি banks.com.bd চালু করেছি। এ ওয়েবসাইট আপনার আশেপাশের ব্যাংক এবং ATM খুঁজে কোনটা কতো দূরে আছে দেখিয়ে দেবে। এছাড়াও কোন ব্যাংকের কতোগুলো শাখা প্রতিটি শহরের কোথায় আছে তা জানতে পারবেন। এর সঙ্গে hotel.info.bd, hospital.info.bd, school.info.bd, college.info.bd, ngo.info.bd, insurance.info.bd, masjid.info.bd,tourist.info.bd, job.info.bd, freelance.info.bd ইত্যাদি ওয়েবসাইটের কাজ চলছে’।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৬
ইএস/এএসআর