ঢাকা, রবিবার, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

ঝুলন্ত পাড়ার জেলেদের হাহাকার

মাহবুবুর রহমান মুন্না, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৬
ঝুলন্ত পাড়ার জেলেদের হাহাকার ছবি: মানজারুল ইসলাম- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর

খুলনা: আগে গাংয়ে (নদীতে) মাছ মারি (মেরে) পরিবার চালাতাম, এহন (এখন) গাংয়ে মাছ পাচ্ছি না, সংসার অনেক কষ্টে চলতিছে, এখন আমাগি গ্রামে কোনো কাজ নেই, অন্য গ্রামে খাটতি (কাজ করতে) যাই, তাতে কোনো রকম চাইল (চাল) কিনার টাকাডা (টাকা) হয়, কিন্তু অন্য কিছু কিনতি পারি না।
 
খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের শিবসা নদীর তীরের কালাবগীর ঝুলন্তপাড়ার জেলে আব্দুল্লাহর জীবন-জীবিকার বর্তমান চিত্র এমন।

তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই পাড়ার নেছাউন বিবি বলেন, আমি আগে নদীতে পোনা ধরতাম, বাদায় মাছ মারতি (মারতে) যাতাম। এখন পোনা ধরা, বাদায় যাওয়া বন্ধ করে দেছে, আর কি করতি পারি, খুব কষ্টে সংসার চুলতেইস, ছিলে (ছেলে)- মিয়ের (মেয়ে) পড়ালিখা বন্ধ হইয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আমার ভিটা মাটি কিচ্ছু নেই, বছরের পর বছর এখানেই থাকি। সরকারি কোনো সাহায্য পাইনি, খুব কষ্টে আল্লাহ বাঁচায়ে রেখিছে, এহন কোনো কাজ কাম নেই, কি কুরে (করে) দু’মুঠো খেয়েই পুড়ে বাঁচবো, তা আল্লাই জানেন।

কয়েকজন জেলে আক্ষেপ করে বলেন, সরকার নদী থেকে মাছের পোনা আহরণ নিষিদ্ধ করায় এবং বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় তাদের কষ্ট আরও বেড়েছে। সরকারিভাবে জেলে কার্ড দেওয়ার কথা থাকলেও অনেকেই তা পাননি। এছাড়া সুন্দরবনের মধ্যে প্রবেশের পাস না পাওয়ায় অধিকাংশ পরিবারের লোকজন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

তাদের মতো একই অবস্থা এখানকার দেড়শ’ পরিবারের।

কালাবগীর ঝুলন্ত পাড়ার পুবে ভদ্রা, পশ্চিমে শিবসা নদী। এই নদীর ওপারে সুন্দরবন। শিবসা নদীর চরে টংঘর তুলে ৩০-৪০ বছর ধরে বসবাস করছেন হতদরিদ্র এ মানুষগুলো। যাদের জীবন-জীবিকা নদী ও সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের অনেক নদীতে মাছ ধরা ও বনের মধ্যে প্রবেশ নিষেধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন এসব মানুষ।

বর্তমানে কর্মহীন এসব মানুষের একমাত্র সম্বল নৌকাটি নদীর ঘাটে বাঁধা। মাটিতে শুকাতে দেওয়া জাল। ছোট ছোট জীর্ণ ঘরে চলছে অভাব।

অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময় দাকোপের বিভিন্ন এলাকার উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ হলেও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি জেলে পল্লীতে। অভাব ঘোচেনি জেলে পল্লীর বাসিন্দাদের। বিভিন্ন এনজিও, দাদনখোরদের জালে বন্দি জেলে পল্লীর মানুষ।

কালাবাগী পশ্চিমপাড়ার ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডকে ঝুলন্ত পাড়া বলা হয় জানিয়ে স্থানীয় সমাজসেবক জিএম রাসেল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ভূমিহীন এসব মানুষেরা ঝড়ের ছোবল, শীতের প্রকোপ, খাওয়ার জন্য মিষ্টি পানির সংগ্রাম, অ-শিক্ষা, রোগ-শোক, অভাব-অনটন নিয়েই বছরের পর বছর বাসবাস করে আসছেন।

সুতারখালী ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সুতারখালী ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে এ ঝুলন্ত পাড়ায় দেড়শ’ পরিবারের বাস। যেখানে বাসিন্দা প্রায় ৪০০-৫০০ জন। ভূমিহীন এসব মানুষ ৩০-৪০ বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন। এদের প্রধান জীবিকা হলো নদী থেকে বাগদা ও গলদার রেণু পোনা সংগ্রহ ও মাছ ধরা। এছাড়া অনেকে সুন্দরবনে কাঠ, গোলপাতা ও মধু সংগ্রহ করেন।

বর্তমানে বনে প্রবেশে কঠোরতা ও নদীতে মাছ কম ধরা পড়ায় এখানকার জেলেদের দিন কাটছে অনেকটা অলসভাবে।
 
স্থানীয় প্রবীণরা জানান, আশির দশক থেকে লাগাতার নদী ভাঙনে পাল্টে গেছে দাকোপের ভৌগলিক চিত্র, পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনের মোকাবেলা করে এ উপকূলের মানুষ রীতিমতো যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। এলাকার হাজার হাজার বিঘা জমি এবং শত শত ঘর-বাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভিটে মাটি হারিয়ে পরিবর্তন এসেছে মানুষের পেশা ও জীবন-জীবিকায়। শতশত মানুষ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন। যাদের উপায় নেই তারা শিবসার তীরে ঝুলন্ত পাড়ায় কষ্ট করে দিনযাপন করছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৬
এমআরএম/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।