হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) ঘুরে এসে: কপালপোড়া সরলা মানকিন। বয়স সাকুল্যে ১০৮ কী ১১০ বছর।
বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া সরলা মানকিন রায়ট দাঙ্গার সাক্ষী। সেই সময়ে হারিয়েছেন নিজের স্বামীকে। একমাত্র মেয়েও বিধবা। ঢাকায় পার্লারে কাজ করেন। মাঝে-মধ্যে মাকে দেখে যান। মাসে মাসে টাকা পাঠান। বয়স কম না হলেও জীবনের স্মৃতি এখনো ঝাপসা হয়নি তার। এখনো স্বামী-সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানোর স্মৃতি মনে করেন।
স্থানীয় দক্ষিণ জয়রামকুড়া গ্রামের আলো-আধারির একটি জীর্ণ ছোট্ট কুঠিরে থাকেন সরলা। তার ঘরে রয়েছে প্রশস্ত মাটির বারান্দা। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় প্রৌঢ় এ নারী পড়াশুনা করতে পারেননি।
সম্প্রতি ওই গ্রামের কাঁচা সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে আলাপ হয় বাংলানিউজের সঙ্গে।
বয়সের কারণেই শরীরের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। চলাফেরার শক্তিও কমে এসেছে। তবুও চালিয়ে যাচ্ছেন জীবন সংগ্রাম। পথেই দাঁড়িয়ে, আবার কখনো হাঁটতে হাঁটতে জীবন কষ্টের স্মৃতিকথা তুলে ধরে বয়োবৃদ্ধা সরলা মানকিন।
ফিরে যান ১৯৬৪ সালের দিকে রায়ট বা হাঙ্গামার দুঃসহ স্মৃতিতে। ওই সময় শারীরিক অসুস্থতায় মারা যান স্বামী। এ বৃদ্ধা জানান, রায়টের সময় অনেক আদিবাসী পার্শ্ববর্তী মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নেয়।
ময়মনসিংহের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আদিবাসীদের ধরে এনে হত্যা করে এখানে মরদেহ ফেলে রেখে যেতো। ওই সময় অনেক আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি দখল হয়ে যায়। কিন্তু তিনি সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এখানেই থেকে যান।
কষ্টকর এ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সরলা মানকিনের চোখ গড়িয়ে জল পড়তে থাকে। চোখের জল না মুছেই বলতে লাগলেন নিঃসঙ্গতাই এখন তার জীবনের সঙ্গী। স্নেহ, মায়া-মমতা আর সহানুভূতির প্রত্যাশী তিনি।
তবে এ নিয়ে মোটেও হ্যাপিতেশ নেই তার কন্ঠে। বলেন, ‘আমি বুড়ো মানুষ, ঘুরি-রান্দি আর খাই। আর কোনো কাম নাই। টেনশনও নাই। ’
কথিত আছে, তিব্বত এলাকা থেকে আসা মঙ্গোলিয়ান জাতিগোষ্ঠী ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এ জনপদে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে ব্যবসায়িক শ্রেণির লোকজনও ওই এলাকায় বসবাস শুরু করে। মূলত দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণেই এখানে আদিবাসীরা থাকতো।
এ কুঁজো বুড়ির মতোই তার মেয়েও অকাল বিধবা। ঢাকায় পার্লারে কাজ করেন। মায়ের জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠান। এ বৃদ্ধা বলেন, ‘পান-সুপারি কিনতে নিজেই বাজারে যাই। হাটঘুরে পান-সুপারি কিনে বাড়ি ফিরি। বাজার-সদাইও নিজেই করি। ’
সরলা মানকিন একাকিত্ব নিয়ে জীবনের এ গোধূলী বেলায় নিঃসঙ্গ প্রহর পার করেন মেয়ের প্রতীক্ষায়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, মেয়েটা কাছে এলে যেন প্রাণ ফিরে পাই। আবার চলে গেলে একাকীত্ব যেন গ্রাস করে।
সরলার সঙ্গে আলাপের সময় সেখানে ছিলেন একই গ্রামের জর্জ সুলেমার। কুঁজো বুড়ির বিষয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, জীবনের সঙ্গে লড়াই করে একাই টিকে আছেন স্বজনহীন, সঙ্গীহীন কুঁজো বুড়ি।
তবুও কারো কাছে হাত পাতেন না। প্রতি বিকেলেই নিজেই বাজার-সদাই করেন। এখনো হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করতে পারেন।
বাংলাদেশ সময়: ০২১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৬
এমএএএম/এসএইচ
**শিক্ষার আলোয় বদলে যাচ্ছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন