ঢাকা, শনিবার, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

ময়লা-আবর্জনায় বুঁজে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৭
ময়লা-আবর্জনায় বুঁজে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা ময়লা-আবর্জনায় বুঁজে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা / ছবি: মিথুন ও রানা

হাজারিবাগ বেড়িবাঁধ ঘুরে: রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে দক্ষিণ দিকমুখী বেড়িবাঁধ গিয়ে ঠেকেছে বাবুবাজার। প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ কাম সড়কটির দু’পাশজুড়ে দোকানপাট ও ছোট-বড় শিল্প কারখানার সারি। 

ঝাউতলা ছাড়িয়ে কামরাঙ্গীর চর ব্রিজে দাঁড়িয়ে খেয়াল হয়, নিচে তো খাল বা নদী থাকা উচিৎ- নাহলে এমন শক্তপোক্ত রড-সিমেন্টের ব্রিজ কেনো! নিচে তাকিয়ে পানির কোনো অস্তিত্ব চোখে পড়লো না, কেবল রাশি রাশি ময়লা-আবর্জনা। যেনো এখানে নিয়ম করে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়!

প্লাস্টিকের বোতল, লোহা-লক্কড়, পুরনো জিনিসপত্র, ময়লা কাপড়, বিস্কুটের-চিপসের প্যাকেট, পায়খানা, প্রস্রাব ইত্যাদি- কী নেই তাতে।

কঠিন, তরল, বায়বীয়- সব ধরনের ময়লা পদার্থের গোডাউন। ময়ল‍া ফেলতে ফেলতে স্তূপাকার রূপ নিয়েছে।

সামনে এগোতে আরও দু’-একটি লোহার ব্রিজ নজরে আসে। মঙ্গলবারের (২৪ জানুয়ারি) সরেজমিনে সেখানেও চিত্র একই। তাহলে খাল কোথায় গেলো!

ময়লা-আবর্জনায় বুঁজে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা

কেঁচো খুড়তে কেউটের মতো, খাল নিয়ে খোঁড়াখুড়ি করতেই বেরিয়ে এলো আস্ত বুড়িগঙ্গা। নদীর অতীত ইতিহাস বলছে, ব্রিজের ওপারে যে বর্তমান জনবসতি তা আসলে বুড়িগঙ্গারই প্রবাহ পথ। শুকনো মৌসুমে চর জাগলে মানুষ বসতি গাড়ে। গড়ে ওঠে বহুতল বাড়ি, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার, কলকারখানা ইত্যাদি। শেষে এমন অবস্থা দাঁড়ায়, জলধারা এদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যপথ খুঁজে নেয়।  

মেলায় হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শিশুর মতো মূল প্রবাহের একটি অংশ খালের রূপ নিয়ে বর্তমান বেড়িবাঁধের কোল ঘেঁষে আলি ঘাটে গিয়ে মিশেছে। অবৈধভাবে দখল ও ভরাট হতে হতে সেই খালরূপী বুড়িগঙ্গাও এখন নেই হয়ে গেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এইসব বহুতল ভবনের জায়গায় একসময় ছিলো বুড়িগঙ্গার ঢেউ।

অবশিষ্ট অংশটুক‍ু বদ্ধ ডোবার মতো মরে পড়ে রয়েছে কামরাঙ্গীর চর ব্রিজের নিচে। এর আগ পর্যন্ত স্লেটে চকের দাগ মোছার মতো মুছে দেওয়া হয়েছে যেনো।  

ময়লা-আবর্জনায় বুঁজে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা

আলি ঘাটের একটু আগ দিয়ে কালো পানির দেখা মেলে। সরু কালো রেখার মতো মনে হয়। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় বলা যায়, সেও কদিন বাদে মুখ লুকালো বলে। বাচ্চা মাকড়সা যেমন মায়ের বুকের মধ্যে থেকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলে মায়ের বুক- তেমনি নদী দখলের বাঁশ-পিলার ধেয়ে যাচ্ছে দুইপাড় থেকে। ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে নদীর বুকে। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার কাজটুকু করে দিচ্ছে আবর্জনার ভাগাড়। অস্বাস্থ্যকর তো বটেই, দুর্গন্ধের চোটে টেকা মুশকিল। এরপরও দিনের পর দিন এভাবে চলছে।

গোটা ঢাকা শহর কুড়িয়ে যতো প্লাস্টিকের বোতল মেলে, সব চলে যায় এই কামরাঙ্গির চর এলাকায়। প্লাস্টিকের যতো পণ্যের কারখানা এ অঞ্চলেই। রয়েছে বেড়িবাঁধের পাড়জুড়ে ওঠা দোকানপাট, ট্যানারি ও অন্যান্য শিল্পকারখানা। সেইসঙ্গে কামরাঙ্গির চরের ক্রমবর্ধমান জনবসতি। সবার ‘ডাস্টবিন’ যেনো এই মৃতপ্রায় অংশটুকু। মূল বুড়িগঙ্গাও রেহাই পায়নি কোনো অংশে। এ হারে চলতে থাকলে, অদূর ভবিষ্যতে ময়লা-আবর্জনায় বুড়িগঙ্গা বুঁজে যাওয়ার শঙ্কা জাগে।  

আমরা সবাই যেনো ওই মাকড়সার বাচ্চা, নদীমাতৃকার বুক কুরে কুরে খেয়ে নিজেরাই বড় হচ্ছি, বেঁচে থাকছি। মায়ের বুকের পুরোটা  
খাওয়া শেষ হতে হতে বড় হয়ে ওঠে বাচ্চা মাকড়সা। ততোদিনে মা মরে গিয়ে শুকনো খোলস বনে যায়। সেটি গা থেকে ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে হাঁটা লাগায় তরুণ মাকড়সা।

ময়লা-আবর্জনায় বুঁজে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা

সম্প্রতি রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রাথমিকভাবে আগামী ০৬ ও ০৯ ফেব্রুয়ারি, নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খাল ও হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার অবৈধ জায়গা দখলমুক্তির জন্য অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন।

স্থানীয়দের সঙ্গে  এ নিয়ে কথা হলে, অনেকেই এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান। অনেকে উপায়ন্তর খুঁজে পান না। তাদের বক্তব্য, বেড়িবাঁধের এ-মাথা থেকে ও-মাথা, দুইপাশের অধিকাংশই অবৈধ স্থাপনা ও দখল হয়ে যাওয়া জায়গা। এখন যে অবস্থায় রয়েছে, কীভাবে এসব উচ্ছেদ সম্ভব হবে! বেশিরভাগ জায়গা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে। প্রভাব খাটিয়ে নদী ভরাট করে দোকানপাট-কারখানা তুলেছেন। সেগুলো আদৌ দখলমুক্ত করা সম্ভব হবে? উল্টো প্রশ্ন রাখেন অনেকে।  

এরপরও কেউ আশা প্রকাশ করেন, কেউ বাস্তবতা তুলে ধরেন। মাকড়সার গল্পের আরেকটু অংশ রয়ে যায়। মায়ের বুক কুরে বড় হওয়া মাকড়সাও একদিন মা হয়!

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৭
এসএনএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।