ঘরের বাইরের দিকটা যেমন গোছানো, ভেতরটাও তেমন। এক দরোজা আর চার জানালার ঘরটায় ৩টা কক্ষ।
মাত্র ৩ মাস আগে এই আবাস গড়তে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হকের খরচ গেছে পৌনে দু’ লাখ টাকারও বেশি। একটি সরকারি ব্যাংক থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাপ্ত ঋণের টাকায় তিনি বাড়িটি তৈরি করেছেন ঢাকার পূর্বের মান্ডা খালের নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী অংশের (জিরানী খাল) ওপর।
দক্ষিণ-পশ্চিমের নন্দীপাড়া থেকে উত্তর-পূর্বে ত্রিমোহনী বাজার যাওয়ার পথে ফজলুল হকের ঘরটা। একেবারেই নতুন এই বাড়িটা নাকি এখন উচ্ছেদ হয়ে যাবে। সে চিন্তায় দু’দিন ধরে ঘুমোতে পারছেন না সত্তরোর্ধ্ব মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল।
তার সঙ্গে দেখা রাস্তার চা দোকানে। ঢাকা থেকে সাংবাদিক এসেছেন শুনে তার স্ত্রী রহিমা আর বোন কামরুন্নেসাও ছুটে এসেছেন দোকানে। সঙ্গে আরও দু’একজন পড়শী।
কামরুন্নেসাই আগে বলেন তার ভাইয়ের দুঃখের কথা, “একটা বাড়ি বানাই দিতে নানাদিকে নানাজনের সাথে কথা বলেও কোনো লাভ হয় নাই। এখন সরকারের এ জায়গার ওপর এতো টাকা খরচ করি বাড়ি করছে। যদি এই বাড়ি উঠাই দেয় যাইবো কই?”
অসহায় হয়ে কামরুন্নেসার এই কথা শুনতে থাকেন রহিমা। কামরুন্নেসা বলে চলেন, তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু সে অর্থে কিছু ভাতা ছাড়া আর কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পান না। সেজন্যই তো সরকারের এ জায়গায় খাল দখল করে বাড়ি বানিয়েছেন।
বাড়ি দেখাতে ফজলুল হক তার ঘরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। একাত্তরে তিনি দেশের জন্য লড়েছেন ৩ নম্বর সেক্টরে, হেজামারার সদরদফতরে প্রশিক্ষণ নিয়ে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে এক হয়ে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করে তবেই ফিরেছেন। যুদ্ধের পর কেউ কেউ সুযোগ-সুবিধা নিতে মনোযোগী হলেও ফজলুল হক তার আগের পেশায় নেমে পড়েন সাদামাটা চিন্তায়। কখনো মান্ডা খাল বা তার আশপাশে মাছ ধরা, কখনো রিকশা চালানো, বা দিনে এনে দিনে খাওয়ার মতো অন্য কাজ।
কিন্তু বয়স শেষে এসেই ঠেকে গেলেন ভাগ্যের কাছে। এখন দুই ছেলে দুই দোকানে কাজ করেও সংসার টানতে পারছেন না। ঋণ নিয়ে নতুন ঘর তুলে ভাড়া বাসা থেকে এসেও স্বাচ্ছন্দ্য আনা যাচ্ছে না সংসারে। এরমধ্যেই এই দুঃসংবাদ, খাল উদ্ধার হবে, ভাঙা হবে তাদের ঘরটাও।
নিজের ঘরে নিয়ে কয়েকবার এই দুঃখই প্রকাশ করেন ফজলুল হক। “আমি এখন ছেলে-পরিবার নিয়ে কই যামু? কতোজনের কাছে কইছি থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ঘর করছি, এখন কই যামু?”
খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ার কারণে রাজধানীতে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এই অবস্থার নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন এদিকের নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খাল, ওদিকের হাজারীবাগের বেড়িবাঁধসহ বেশ কিছু এলাকা অবৈধ দখল থেকে উদ্ধারের ঘোষণা দেন।
মেয়র তো কোটি নগরবাসীর চিন্তা করেই খাল উদ্ধারের ঘোষণা দিয়েছেন, তাছাড়া এটাতো সরকারেরই জায়গা। এ কথা বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে খানিকটা চুপ থাকেন ফজলুল হক। এরপর বলে ওঠেন, “দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে আমরাও তো মুক্তিযুদ্ধে গেছি। প্রাণ বাজি করেছি। ”
তাহলে কি সরবেন না খাল থেকে? এ প্রশ্ন করলে ফজলুল হকের স্ত্রী রহিমাই বলেন, “সরকারের জায়গা সরকার নিয়ে যাবে। কিন্তু আমরা কোথায় থাকবো, সে ব্যবস্থা সরকার করে দিক। আমরা কাজকর্ম করে খাবো। কিন্তু থাকার ব্যবস্থাটা করে দিক। ”
আরও পড়ুন....
**স্বচ্ছ জলে নৌকা বাওয়ার স্বপ্ন বুড়িগঙ্গায়
** উচ্ছেদের ঘোষণায় হাত গোটালো দখলদাররা
** নদীর খালও মরে দখলের খাঁড়ায়
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৭
এইচএ/