প্রতিদিনই এভাবে চাকরিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থী এবং মহিলাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তাদের জন্য বরাদ্দ ৯ সিটের বাইরে আর কোন নারীকে বাসে নিতে চায় না বাস কর্মীরা।
বাংলামোটর মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী সাথী আকতার। তার গন্তব্য পুরান ঢাকায় নিজ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তিনিও পড়েছেন সিট না থাকার গ্যাড়াকলে।
বলেন, আগেও সমস্যা হতো বাসের মধ্যে, এখন তো বাসেই উঠতে দেয় না হেলপাররা। প্রতিদিন প্রায় যুদ্ধ করে এই সড়কে যাতায়াত করতে হয়। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় লাগে।
প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন সুমাইয়া সাবা। তিনি বলেন, গাদাগাদি করে তো তারা অন্যদের নিচ্ছেন শুধু আমাদের নিতে সমস্যা। পুরুষদের জন্য আমাদের পড়তে হচ্ছে নানা ভোগান্তিতে। অনেক সময় দেখা যায় অফিস থেকে বাসায় যেতে রাত হয়ে যায়।
বাসের ভোগান্তিতে পরে অনেককে ফেসবুকে স্টাটাস দিতেও দেখা গেছে। তনয়া মুস্তারিন নামের ফেসবুক ব্যবহারকারী স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘এতদিন শুধু কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের পুরুষদের জন্য রাস্তাঘাটে মেয়েদের চলা মুশকিল ছিলো। আর এখন! এইসব পশুদের জন্য বাসে মেয়েদের সমস্যা হয় বলে ঝামেলা এড়াতে মেয়েদের বাসে উঠতে দেয় না হেলপাররা। এখন জাতির কাছে প্রশ্ন, আমরা যারা রোজ রোজ সিএনজি এফোর্ড করতে পারি না তাদের জন্য বিকল্প পথ কি?’
আফসানা এ রিপা নামের আরেক ফেসবুক একাউন্ট ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘পাক্কা দেড় ঘণ্টা ধরে বনানীতে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তায় অনেক বাস। কিন্তু সব পুরুষদের জন্য। মেয়ে মানুষ বলে বাসের কাছেই যেতে দেয় না হেলপাররা। দাঁড়িয়ে যাবো বললাম, তবুও না। যেন মেয়েরা মানুষ না এলিয়েন। এখন সিএনজি খোঁজো। অর্ধেক মাসের বাস ভাড়া একদিনে শেষ করো। ’
বাস্তবতা যাচাই করতে এক বাস চালক রতনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কি কারণে তারা সিটের বেশি মহিলাদের বাসে তুলতে চান না। তিনি বললেন, ‘মহিলারা উঠলেই গ্যানজাম হইবই। দেখা যায় অনেক সময় মারামারিও লাইগা যায়। এগুলান যাতে না হয় সে জন্যই সিট ছাড়া মহিলাগো নেওন যায় না। ’ উত্তর রতনের।
হেলপার সামাদ দিলেন আরেক যুক্তি। ‘অফিসের বা ভিড়ের সময় একটা মহিলার জায়গায় ৩ জন লোক (পুরুষ) নেওন যায়। মহিলারা দাঁড়াইলেই তাগো সাইড দিতে হয়। হেল্লাইগা ভিড়ের সময় মহিলাগো বাসে উঠাই না। ’
তবে এ সমস্যার মূল কারণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বলে মন্তব্য করলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম। তিনি বলেন, সবার আগে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। সরকার তো বাসে বাসে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। সেটা সম্ভবও না। সেক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি তো আগে পাল্টাতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যেভাবে হচ্ছে সামাজিক অগ্রগতি ততোটা হচ্ছে না। বরং দিন দিন বাড়ছে অশ্লীল মানসিকতা। তবে বাসে এ ধরনের সমস্যা এড়াতে বাস মালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
‘নারী উন্নয়ন শক্তি’র নির্বাহী পরিচালক আফরোজা পারভীন বলেন, রাস্তাঘাটে নারীদের হেনস্তা সম্পর্কিত যে মামলাগুলো হচ্ছে সেগুলোর কোথাও বিচার হচ্ছে না। ফলে মেয়েদের সাথে অশ্লীল আচরণ বেড়েই যাচ্ছে। বিচার না হলে এ সমস্যার সমাধান কোনদিনও হবে না। কর্মজীবী এবং ছাত্রীদের বাসের এ সমস্যা সমাধানে বাসের ড্রাইভার এবং হেলপাররা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাহলে এ সমস্যা অনেকটা সমাধান করা সম্ভব। এছাড়াও রাজধানীর পয়েন্টে পয়েন্টে বাসের নম্বর নিয়ে অভিযোগ করার সিস্টেম থাকলেও ভালো হয় মেয়েদের জন্য।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে তার পাবলিক রিলেশন অফিসার নাসের টিটু বাংলানিউজকে জানান, মহিলা এবং শিশুদের হয়রানি বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। হয়রানি বন্ধে সে কমিটি কাজ করছে। এছাড়া মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র মহিলা বাস আছে ১৪টি। সর্বশেষ শাপলা চত্বর থেকে আরেকটি বাস চালু করা হয়েছে।
তবে এসব বাস নিয়মিত কি না সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিয়মিত। কিন্তু অনেকগুলো রুটে চালু থাকে বলে চোখে পড়ে না। তবে এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো সকালে অফিসে মহিলাদের দেওয়ার পর সারাদিনে আর কোন মহিলা যাত্রী পাওয়া যায় না। তারপরও আমাদের কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে মহিলাদের জন্য ৯টা সিট খালি রাখার জন্য। ’
এ বিষয়ে বিআরটিএ সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী বলেন, এ ধরনের অভিযোগ পেলেই আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমাদের মোবাইল কোর্টেরও ব্যবস্থা রয়েছে। অথবা অনেক সময় নারী পুলিশ বা সামনে থাকা ট্রাফিক পুলিশের কাছে অভিযোগ আসে। তখন তারাই ব্যবস্থা নিতে পারে। যদি ১শ’ জন মহিলাও আগে ওঠে তাহলে মহিলাদেরকেই নিতে হবে। বাস হেলপারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই আমরা ব্যবস্থা নেব। কারণ মহিলা যাত্রীদের সাথে এমন আচরণ করার কোন সুযোগই তাদের জন্য নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৭
জেডএফ/আরআই