রঙিন লালাখাল
মাঘের দিনের মধ্যভাগে পাহাড়ি নদীটির বাঁকে বাঁকে জীবন জেগে উঠেছে। কি এক জাদু আছে জায়গাটার। জংলা টিলা ছাপিয়ে দূরের আবছা পাহাড় সারির আড়াল ভেদ করে কাঁটাতা হীন সীমান্ত ভেদে তার আগমন এ দেশে। মাঝে চুনা পাথুরে তলদেশ আর দুই পারের ভূমিস্তরের কল্যাণে ধারণ করেছে কোথাও সবুজ কোথাও নীলের সহযোগে পান্না রঙের বাহার।
আমরা এসে দাঁড়ালাম তার পারে। ততক্ষণে এই মধ্য দুপুরে জড়তা ঝেড়ে ছেলে বুড়ো নারী আর তাদের পোষ্যরা ঝাঁপিয়ে তোলপাড় করছে নিস্তরঙ্গ জলধারা।
আমরাও দুপুরের বাড়ন্ত সুরের কল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাল খুঁজছি। একসময় সাহসটুকু করেই ফেললাম। কিন্তু গোঁড়ালি থেকে হাঁটু হয়ে বুক পর্যন্ত জলে যেতে যেতেই সূর্যের সে তাপ ভোজবাজির মতো উবে গেলো। মাইনাস ডিগ্রি সেলসিয়াসের ছোট ভাই টাইপের ঠাণ্ডা জল শরীর কেটে কেটে নিচ্ছে। নতুন এক ফন্দি আঁটলাম। অন্যরা তীরে ক্ষানিকটা কসরত করে শরীর গরম করে এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমিও জল তোলপাড় করতে করতে পড়লাম ঝাঁপিয়ে। শরীর মন জুড়িয়ে জুড়িয়ে গেলো নিমিষে। আসলে গত কদিনের শীতের দাপটে শরীর জলস্পর্শহীন ছিলো কিনা!রাতে এক ভয়ানক শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সূর্য না ওঠা ভোরে এসে পৌঁছি সিলেট। তাপমাত্রা দশের ঘরে ওঠা-নামা করছে। বাস যখন নামিয়ে দিয়ে গেলো রীতিমতো ভয়াবহ শীতের দাপট। দিগন্তে লাল ছটা লাগেনি, কোনো রকমে কাঁপতে কাঁপতে কাউন্টারে এসে বসলাম। ঘণ্টাখানেক দাঁত-মুখ খিঁচে সেখানেই বসে থাকা। সাতটা নাগাদ সকালের নাস্তা খেয়ে শীতাক্রান্ত জনমানবহীন সিলেট নগরীর ধোপা দিঘীর পাড়ে এসে পৌঁছালাম সিএনজি অটোরিকশার খোঁজে। যাবো কানাইঘাট। লাইনের সিএনজিতে গুঁটিসুটি মেরে বসে চালক। আমরা চারজন যাত্রী কিন্তু ছাড়তে হলে হতে হবে পাঁচজন। শেষে বাড়তি একজনের টাকা দিতে রাজি হওয়ায় চালু করানো গেলো। যন্ত্রযানের আবরণবিহীন দরজা দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস একেবারে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তার উপর আবার রাতের নিদ্রাহীন বাস যাত্রার ধকল। আমরা যাচ্ছি লোভা নদীতে। সেখানে আছে লোভাছড়া চা বাগান। সিএনজি সিলেট নগরী ছাড়িয়ে তামাবিল হাইওয়েতে পড়তেই সেই চিরচেনা সিলেটি রূপের বাহার চারপাশে। ফসল কাটা খালি ক্ষেত রিক্তের বেদনে বিষণ্ন না হয়ে বরং ভোরের আলোয় পূর্ণতার তৃপ্তিতে গরবিনী। দিগন্তবিস্তারী সেই ফসলের ক্ষেতের ওপারে আছে নিঝুম কোনো গ্রাম। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে কোলাহলে মুখর হবে। আমাদের পরিকল্পনা লোভা নদীতে স্নান করবো। পাহাড়ি জলধারায় গা ভাসিয়ে ধন্য হবো। আশার বেলুন চুপসে গেলো নদীর পারে গিয়ে থামতেই। তার বুকে চলছে পাথর তোলার আয়োজন। সর্বত্র যন্ত্রদানবের বিচরণ। সহযাত্রীর কিছুদিন আগে দেখে যাওয়া সুন্দরী লোভা নদীটি আর নেই। ক্রমাগত পাথর তোলায় সে মৃত প্রায়। তবে সুদূরের আহ্বান জানিয়ে রাখলো দূরের আবছা মেঘালয় পাহাড় সারি। আমরা ছুটলাম সেই দিকে, যত দূর যাওয়া যায়। লোভাছড়া চা বাগানে আছে ব্রিটিশ যুগের নির্মিত এক লোহার ব্রিজ। তাকে কেন্দ্র করে ফটোসেশন হলো। লালাখাল দেখা হয়নি। বহুল শোনা সেই আলোচিত রঙিন জলধারা দেখতে ছুট লাগালাম অপ্রচলিত পথ ধরে জৈন্তাপুরের দিকে। এ পথে সাধারত যানবাহন চলে না। চা বাগান পাশে রেখে কখনো টিলার অলিগলি ধরে সিএনজি অটোরিকশা চলছে। সকালের সেই হাড় কাঁপানো শীত আর নেই। সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে। এক বালুময় ঢিবির গোঁড়ায় এসে থামলাম আমরা। এরপর আর যাওয়ার উপায় নেই। কেউই জানি না ওপাশে কি আছে।
দুরু দুরু বুকে ক্ষানিকটা উঠে গেলাম। জাদুর বাক্সের মতো পরিবর্তন হয়ে গেলো চারপাশটা। একি!! ঠিক ওপারেই একেবারে রঙিন পানির ধারা বুকে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটি নদী। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করতে যতক্ষণ। জীবন এই জলপথের প্রতিটি কোণ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে। পাথর শ্রমিক, নৌকার মাঝি, আনন্দ বিহারে আসা পর্যটক সবাই যেন এই আনন্দযজ্ঞের শরিক। ঘোর শীতের শীর্ণ এ জলধারাও কতটা সুন্দর। কি রঙ এর? সবুজ, নীল নাকি পান্না। নিজ চোখে এসে দেখে যাবেন। তবে আসতে হবে শীতেই। বর্ষার পাহাড়ি পলিবাহিত ঢলে এ রং হয়ে যাবে ঘোলা। নদীর পারের ছোট্ট বাজারে ডিমভাজা ভাত-ডালের অর্ডার দিয়ে চরলো ঝাঁপাঝাঁপি। তারপর ভরপেট খাওয়া। নৌকা ভাড়া করে দশ পনেরো মিনিট দূরে ভারত সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে ঘুরে এলাম। মূলত সারি নদীর জিরো পয়েন্ট থেকে ঘাট অবধি অংশটুকুকে বলে লালাখাল।
নৌকা থামিয়ে পড়ন্ত সূর্যের হারিয়ে যাওয়া অবধি চুপ করে বসে চারপাশকে ভেতরের ক্যামেরায় গেঁথে নিলাম। শেষ বেলায় পাখিরা ঘরে ফিরছে। নদীর স্রোতের কিন্তু বিরাম নেই। আমরা ফিরে এলাম বিরামহীন পথচলার নিয়ম মেনে।
জানা প্রয়োজন: লালখালে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় শীতকাল। বর্ষার পাহাড়ি ঢল নামলে হারিয়ে যায় পানিতে রঙের বাহার। সিলেট শহরের ধোপাদিঘীর পার থেকে জাফলংগামী হিউম্যান হলারে চলে আসুন জৈন্তাপুর উপজেলার সারিঘাটে। সময় লাগবে দেড় ঘণ্টা। ভাড়া ৩০ টাকা। এছাড়া শহরের কমদতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস পাওয়া যাবে। আর আধাবেলার জন্য সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করলে খরচ পড়বে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকার মতো।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৭
এএ
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।