আরেকটি কক্ষে প্রবেশ করতেই নাকে ভেসে এলো উৎকট গন্ধ। এখানকার টেবিলে রাখা হটপট।
একটি আলমারির ওপরে ছড়ানো ছিটানো ওষুধপত্র। আর ফ্রিজে ভ্যাকসিনের বদলে রাখা হয়েছে মাছ-মাংস। এর সঙ্গে রশিতে ঝুলছে কাপড়-চোপড়।
আবার গেটের ঠিক পাশের কক্ষে চেয়ার-টেবিল থাকলেও জানালার বেশিরভাগ কাচ ভাঙা। অনেকদিন চুনকাম না হওয়ায় দোতলা ভবনটির চেহারাও বিবর্ণ।
দেয়াল থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। টেবিলে পত্রিকার কাগজে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে গবাদি-পশুর অল্প কিছু ওষুধপত্র। তালা ঝুলছে বাইরের প্রশিক্ষণ ভবনেও। দুর্দশা ও অব্যবস্থাপনার এ চিত্রটি ময়মনসিংহ জেলা প্রাণী হাসপাতালের।
সাইনবোর্ড ছাড়া বোঝার কোন উপায় নেই যে এটি প্রাণী হাসপাতাল। এর মরণদশার কারণে এখানে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি বা বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির চিকিৎসার জন্য কেউ আসেন না বললেই চলে।
মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঘণ্টাখানেক হাসপাতালে অবস্থান করেও কোন পশু-পাখিকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এমন চিত্র চোখে পড়লো না।
এ করুণ দশার কারণেই গবাদিপশুকে চিকিৎসা নেয়ার জন্য ছুটতে হচ্ছে ঠিক পেছনের সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ে। ফলে ন্যূনতম কাজেও আসছে না জেলার একমাত্র এ প্রাণী হাসপাতালটি।
প্রায় এক যুগ আগে ময়মনসিংহ নগরীর বাউন্ডারি রোড এলাকায় গড়ে ওঠে জেলা প্রাণী হাসপাতাল। ওই সময় প্রচুর পরিমাণে গবাদি পশুকে চিকিৎসার জন্য নেয়া হতো এখানে।
শুরুর দিকে এ হাসপাতালে একজন করে ভেটেরিনারি কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি সার্জন (চিকিৎসক), ভেটেরিনারি কম্পাউন্ডার, এমএলএসএস, অফিস সহকারী ও চিকিৎসার কাজে সহায়তার জন্য একজন বুল অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন।
কিন্তু বছর দুয়েক আগে ভেটেরিনারি কর্মকর্তা পদটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। শূন্য রয়েছে বুল অ্যাটেনডেন্ট বা সেবিকা পর্যায়ের পদটিও। তাছাড়া এখানকার ভেটেরিনারি সার্জন (চিকিৎসক) বা অন্যরা দায়িত্ব পালনের বদলে ফাঁকিবাজি করায় দিন দিন গুরুত্ব কমে আসছে এ হাসপাতালের।
দিনের পর দিন বন্ধ থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পূর্ণাঙ্গ একটি ল্যাব থাকলেও তা কাজেই আসছে না। অথচ এ ল্যাবে রয়েছে শল্যচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় লাখ লাখ টাকার অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি।
সরেজমিনে অফিস টাইমে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেলো পিনপতন নীরবতা। প্রবেশ গেট খোলা থাকলেও হাসপাতালের ভেতরের গেটটিতে তালা ঝুলানো।
কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন ভেটেরিনারি সার্জন (চিকিৎসক) এস.এম.হাসান আলী ফারুক। সংবাদ কর্মী পরিচয় জানতে পেরে গেটের তালা খুলেই তিনি ল্যাবরেটরি ঘরের পাশের কক্ষটিতে দৌড়ে দরজা বন্ধ করতে গেলেন। পেছনে ছুটে গিয়ে দেখা গেলো, একটিতে উৎকট দুর্গন্ধ। ভেতরের অবস্থাও কাহিল। যেন ঠিক রান্নাঘর।
ছবি না তুলতে অনুরোধ জানিয়ে এবার গেটের পাশের কক্ষে নিয়ে গেলেন। এ কক্ষে চেয়ার-টেবিল মিললেও আরেকটি টেবিলের অবস্থা বেশ এলোমেলো।
এখানকার কক্ষে খানিক আলাপ করেই সুযোগ বুঝে কেটে পড়লেন এ চিকিৎসক। আর তখন দোতলা থেকে নেমে এলেন ভেটেরিনারি কম্পাউন্ডার মোশরেখা আক্তার।
বলতে থাকলেন, কোন কিছু জানার থাকলে আরেকদিন আসুন। চিকিৎসককে ডাকার কথা বললে তিনি নিজের অপারগতার কথা জানালেন।
আলাপের সময়েই ওই চিকিৎসক ফারুক আবার হাসপাতালের গেটে প্রবেশ করেই সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে বাইরে চা খাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে পাততাড়ি গুটাতে থাকলেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ী শহীদ উদ্দিন বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ করে বলেন, জেলার একমাত্র এ প্রাণী হাসপাতালে এখন আর গবাদি পশুর দেখা মেলে না। চিকিৎসাও জোটে না। তবে একটু-আধটু চিকিৎসা মিলছে পেছনের উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ে।
একই রকম তথ্য দেন সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মলয় কান্তি। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, জেলা প্রাণী হাসপাতালে খুব একটা মানুষজন যায় না। তবে এটা দেখার দায়িত্ব আমার নয়।
কৌশল পাল্টে এরপর আবারো ভেটেরিনারি সার্জন (চিকিৎসক) এস.এম.হাসান আলী ফারুকের মুখোমুখি হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যৎসামান্য গবাদি পশু আসে। দিনে ৪ থেকে ৫টি গবাদি পশুর চিকিৎসা দেয়া হয়।
কক্ষগুলোর এমন হালের বিষয়ে না লেখার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আপনারা যা দেখলেন তা লিখলে আমার চাকরির ক্ষতি হবে। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা আমাদের প্রতি বিরক্ত হবেন। ’ এরপর তিনি আবারো হাতের কারসাজিতে ম্যানেজ করার প্রাণপন চেষ্টা চালান।
এসব বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. আফতাব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, প্রকল্প না থাকার কারণে হাসপাতালের ল্যাবরেটরি বন্ধ রয়েছে। ক’দিন ধরে হাসপাতালটি ভিজিটে যাওয়া হয়নি। তবে অব্যবস্থাপনার বিষয়ে অবশ্যই খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৭
এমএএএম/আরআই