তার পৈত্রিক বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলায়। দেশ স্বাধীনের পর তার বাবা ছাপরহাটি গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন।
গ্রেফতারের আগে তিনি পরিবার নিয়ে বগুড়া জেলা শহরের গরীব শাহ ক্লিনিকের চারতলা ভবনের ওপর তলায় বসবাস করতেন। তার স্ত্রী ডা. নাছিমা বেগম। তিনি পেশায় একজন সরকারি চিকিৎসক।
কাদের খাঁন গাইবান্ধার সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগ দেন। সেখানে চাকরিকালীন তিনি মেডিসিনে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
দীর্ঘদিন সেনাবাহীনিতে চাকরি করার পর ২০০৪ সালে কর্নেল হিসেবে অবসর গ্রহণের পর নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর এলাকায় পরিচিতি লাভ করার জন্য শুরু করেন ফ্রি চিকিৎসা।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাঁচপীরহাট, শোভাগঞ্জহাটসহ উপজেলা শহরে কয়েকটি ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প গঠন করে নিজেই চিকিৎসা দিতেন। এভাবে ২০০৫ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন আব্দুল কাদের খাঁন।
এরপর তিনি জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে লবিং করে ২০০৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন নিয়ে লাঙল প্রতীকে সংসদ নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থীর হয়ে নির্বাচন করেন। এতে জামায়াত নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আবদুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন।
সেসময় তিনি জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরে তাকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। এরপর অবশ্য তিনি আর দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাননি। এমনকি জেলা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে জাতীয় পার্টির কোনো পদে ছিলেন না আব্দুল কাদের খাঁন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে সুন্দরগঞ্জ-১ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন প্রয়াত মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। তিনি এমপি হওয়ার পর আব্দুল কাদের খাঁনের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য দেন দুদকে। এছাড়া বেশ কয়েকটি মামলাও করেন। এসব মামলায় দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়ে ৪টি মামলা তদন্ত করেন। এরপর থেকে লিটনের বিরোধীতা করতে থাকেন আব্দুল কাদের খাঁন।
এদিকে, এমপি লিটনকে সরিয়ে পুনরায় ওই আসনের এমপি নির্বাচিত হওয়ার উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতার লোভ থেকে গত এক বছর আগে কাদের খাঁন তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। অবশেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী মেহেদী হাসান, শাহীন, হান্নান ও রানা নামের চার কিলারকে বিভিন্নভাবে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেন।
এদিকে, চার কিলার মেহেদী, হান্নান, শাহীন ও রানা অবৈধ অস্ত্র নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই ও রাহাজানি করতো। ১ ডিসেম্বর গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে ধোপাডাঙ্গায় ফাইম নামে এক কলেজছাত্রের মোবাইল ফোন ছিনতাই করে তারা। পরে নিজেদের অজান্তে তাদের পিস্তলের ৬ রাউন্ড বুলেট ভরা ম্যাগজিনটি রাস্তায় পড়ে যায়। পরে পুলিশ গুলিভর্তি ম্যাগজিন উদ্ধারের পর থানায় জব্দ তালিকা করেন। ওই ম্যাগজিন এবং মোবাইল ফোনের সূত্র ধরেই এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের ক্লু খুঁজে পায় পুলিশ।
লিটন হত্যাকাণ্ডের আগে গত ১৯ অক্টোবর ভারতে যান কাদের খাঁন। ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করেন তিনি। তবে ভিসা-পাসপোর্টে ভারতে অবস্থান করলেও লিটন হত্যা মিশন সফল করতে চোরাইপথে তিনি দু/তিনবার বাংলাদেশে আসা যাওয়া করেন বলে রিমান্ডে জানা গেছে বলে দাবি পুলিশের।
কাদের খাঁন গ্রেফতারের পর থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপরহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপরহাটি খানপাড়া গ্রামে তার বাড়িতে বুধবার বিকেল পর্যন্ত পুলিশ পাহারা দেখা যায়। ওই বাড়িতে কাদের খাঁনের এক ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাতিজি রয়েছে।
ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজু আহম্মেদ বলেন, ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর শিশু সৌরভকে গুলি করার ঘটনায় এমপি লিটন গ্রেফতার হওয়ার পর কাদের খাঁন সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় উপ-নির্বাচনের অপপ্রচার চালাতে থাকেন।
জেলা জাতীয় পার্টির (জাপা) সভাপতি আব্দুর রশিদ সরকার জানান, হঠাৎ করেই জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে যোগ দেন আব্দুল কাদের খাঁন। এরপর এমপি নির্বাচিন হন। তবে তার সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের তেমন যোগাযোগ ছিল না।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ সার্কেল) রবিউল ইসলাম জানান, লিটন হত্যার রহস্য উন্মোচন হয়েছে। গ্রেফতার আব্দুল কাদের খাঁন হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডে তিনটি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। দু’টি অস্ত্র পুলিশ হেফাজতে রয়েছে, বাকীটি কাদের খাঁনের। এছাড়া আরও কোন অস্ত্র আছে কিনা সে ব্যাপারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৮ ঘণ্টা, ০১ মার্চ, ২০১৭
আরএ