ঢাকা, বুধবার, ৮ মাঘ ১৪৩১, ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

কেমন আছেন এসিডদগ্ধ সুবর্ণা?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৭
কেমন আছেন এসিডদগ্ধ সুবর্ণা? মাহফুজা আক্তার সুবর্ণা- ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: প্রেমের টানে বিয়ে। স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী হয়েও সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেওয়া। অভাব-অনটনের মধ্যে থেকেও স্বামীর মন রক্ষা করে চলেছেন। একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যত ও একটু ভালোভাবে বাঁচতে একটি ফ্যাশন হাউজে চাকরি নেন এইচএসসি পাস মাহফুজা আক্তার সুবর্ণা।

ক্রমেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়া স্বামী ‍সুরুজ আলম খানের ধারণা, শিক্ষিত মেয়ে চাকরি করলে আর তার নিজের ঘরে থাকবে না। শুধু স্বামীর এ ধারণাই কাল হলো সুবর্ণার।

স্বামীর ছোড়া এসিডেই ঝলসে গেলেন তিনি। সহায়-সম্বলহীন সুবর্ণা প্রাণে বেঁচে গেলেও সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে বারবারই আঁতকে উঠছেন।

গত বছরের ৭ এপ্রিল সুরুজ (৪৫) পূর্বপরিকল্পিতভাবে তার দুই সহযোগী শফিউল ইসলাম রিপন (৩৮) ও সেলিম হাওলাদারকে (৩৮) নিয়ে বাসায় যান। সুরুজ আলমের নির্দেশে সহযোগীরা সুবর্ণাকে এসিড নিক্ষেপ করে। এতে তার মুখ, বাঁ চোখ ও শরীরের বাঁ দিকের একাংশ দগ্ধ হয়। এ সময় তাদের সন্তান সানজিদা সুলতানা রিমাও (৯) খানিকটা দগ্ধ হয়।

স্ত্রীকে এসিড ছুড়ে হত্যাচেষ্টার মামলায় স্বামী সুরুজসহ তিনজনকেই আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সেই সঙ্গে স্ত্রীকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

গত রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান এ রায় ঘোষণা করে আসামিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

এসিডদগ্ধ হওয়ার প্রায় এক বছর পর কেমন আছেন সুবর্ণা? জানতে রূপনগর ধানাধীন টিনশেড এলাকায় তার স্বামীর বাড়িতে গেলে সুবর্ণা জানান, তিন মাস ২৭ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর থেকে ওই বাড়িতেই থাকছেন। চিকিৎসক জানিয়েছেন, সুস্থ হতে দুই বছর সময় লাগবে।

এত বড় ঘটনার পর স্বামীর বাড়িতেই থাকছেন কোনো সমস্যা হচ্ছে না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে এখানকার কেউ আমাকে কোনো সহযোগিতা করেনি। এখনও বিভিন্নভাবে আমাকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা।

বাড়ি থেকে নামাবি তো আগে নামাইতি। এখন পঙ্গু বানায় দিয়া অচল কইরা দিয়া কেন নামাবি?, বলেই কণ্ঠ ভারী হয়ে যায় সুবর্ণার।

একতলা বাড়ির ছাদে বানানো কয়েকটি রুমের একটিতে মেয়েকে নিয়ে থাকেন সুবর্ণা। বাসায় যেতেই এসিডে এক চোখ হারানো সুবর্ণা বলেন, আরেকটা চোখে দেখি কিন্তু সবকিছু ঝাপসা। ডাক্তার বলছে অপারেশন না করলে ঠিক হবে না।

অতীতের স্মৃতি হাতড়ে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ভালোবেসে বাবা-মায়ের অমতে ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর সুরুজকে বিয়ে করি। তার প্রথম স্ত্রী আছে সেটা জেনেও ভালোবাসার জন্য সবকিছু মেনে নেই।
 
মিল্কভিটার শ্রমিক সুরুজ প্রথম থেকেই নিয়মিত সংসারের খরচ বহন করতো না। মেয়েটা বড় হচ্ছে ভেবে ১২ বছর সংসার করার পর চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন সুবর্ণা। কিন্তু সুরুজ তাকে কখনোই চাকরি করতে দিতে চাননি।
 
আদালতে জবানবন্দিতে সুরুজ জানিয়েছেন, তার বন্ধুরা বলছে, সুবর্ণা শিক্ষিত মেয়ে। সে চাকরি করলে আর সুরুজের সঙ্গে থাকবে না। এসব ভেবেই সুবর্ণাকে এসিড মারার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ৭ এপ্রিল সকালে তার দুই সহযোগীকে বাসায় এনে সুবর্ণাকে এসিড মারেন।
 
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সুবর্ণা বলেন, ডাক্তার বলেছেন, চোখ একটা নষ্ট হইয়া গেছে। চোখ অপারেশন করতে হবে। বাম কানটা পড়ে গেছে। পোড়া শরীরে কিছুদিন পরপরই সার্জারি করতে হচ্ছে।
 
‘কিন্তু এ অবস্থায় চিকিৎসার ব্যয় বহন করার মতো কেউ নেই আমার। আমার বাবা-মার টাকা পয়সা যা ছিল সব আমার পেছনে খরচ করেছে। প্রথম তিন মাসেই এক লাখ ৪৬ হাজার টাকা খরচ করছে তারা। ডাক্তার বলছে, ভালো ভালো খাইতে। কিন্তু খাইতে পারছি না। ঘরে শুধু ভাত। চারটা আলু সিদ্ধ করে দিছি মেয়েটারে। মেয়েটা ফাইভে পড়ে আজকে পর্যন্ত একটা গাইড কিনে দিতে পারি নাই,’ দুঃখভারাক্রান্ত সুবর্ণা বলেন।
 
সুবর্ণার আকুতি, এখন আমার আশা-ভরসা-স্বপ্ন কিচ্ছু নাই। বাঁইচা থাকার জন্য, চারটা খাওয়ার জন্য আর এই মেয়েটার জন্য সুস্থ হইতে চাই। কাজ করতে চাই। অসহায়ের পাশে কি কেউ নাই? অসহায়রা কি বাঁচব না? তারা কী পৃথিবীতে থাকব না?
 
কাঁদতে কাঁদতে সুবর্ণা বিড়বিড় করে আরও বলেন, আল্লাহ আমার চোখের আলোডা ফিরায়া দাও...
 
সুবর্ণার পোড়া চোখেও অশ্রু ঝরে, ঝাপসা চোখেও বেঁচে থাকার স্বপ্ন। পাশে বসেই মায়ের আহাজারি দেখে শিশু রিমা, যাকে ঘিরেই সুবর্ণার স্বপ্ন।
 
বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৭
পিএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।