ফাল্গুনী ভোরের ছেড়ে যাওয়া শিশিরবিন্দুতে ভিজে প্রতিটি ডালের গুটি আরও উজ্জ্বল সবুজ হয়ে উঠেছে। রাতে শীত আর দিনের গরম আবহাওয়ায় যেনো খাপ খাইয়ে উঠেছে আমের ছোট্ট দানাগুলোও।
এখন পর্যন্ত মুকুল ও গুটি ঝরার মতো কোনো ক্ষতির মুখে পড়েননি চাষিরা। তবে এমন খরা পরে রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেই বিপদ। এতে গাছ এবং ফলনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না হলে এবারও বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
এ বছর রাজশাহীতে প্রায় ৯০ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছিল। সেই মুকুল থেকে এখন ধীরে ধীরে গুটি আসতে শুরু করেছে। বর্তমানে আমের প্রায় আড়াইশ’ জাতের মধ্যে আগাম ও মধ্যম জাতের আমগাছে গুটি এসেছে। দেরিতে গুটি আসবে গোপাল, ফজলি, আশ্বিনাসহ আরও বেশ কয়েকটি জাতের।
রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার মথুরা গ্রামের আমচাষি নুরুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, হপার পোকার আক্রমণ দূর করতে সাধারণত দু’বার আমগাছে ওষুধ স্প্রে করতে হয়। এর মধ্যে গাছে পুরোদমে মুকুল আসার পর একবার আর গুটি ধরার পর একবার স্প্রে করতে হয়। এছাড়া গাছের গোড়ায় পানি দেওয়াসহ নিয়মিত যত্নআত্তি করতে হয় মৌসুমজুড়েই। ডিসেম্বরের শেষে মুকুল আসার পর জানুয়ারিতে ওষুধ স্প্রে করা হয়েছে। পুরোদমে গুটি আসার পর মার্চের শেষভাগে আরও একবার স্প্রে করতে হবে। তবে ঠাণ্ডা-গরম আবহাওয়া নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।
এক প্রশ্নের জবাবে নুরুল আমিন বলেন, একটা সময় ছিল যখন অন ইয়ার ও অফ ইয়ার নিয়ে একটা ফ্যাক্টর ছিল। একবছর ভালো আম হলে অন্য বছর হতো না। যে বছর ভালো হতো সেবছর বলা হতো অন ইয়ার। অন্য বছর অফ ইয়ার। কিন্তু এখন আর অফ ইয়ার-অন ইয়ার নেই। চাষির নিয়মিত পরিচর্যায় প্রতি বছরই আমের ভালো ফলন হয়। আর সেই আমের সুখ্যাতি তাই দেশ জুড়েই।
আম গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, রাজশাহীকে বলা হয় আমে রাজধানী। তাই উত্তরের এই জেলায় আম বাগানে মুকুল আসলেই কেনাবেচা শুরু হয়ে যায়। পাতা দেখে মুকুল, মুকুল দেখে আমের কড়ালি (গুটি) এভাবে চাক্রাকারে মৌসুমভরেই চলে কেনাবেচা। আম ও তার দাম দুটোই একটু একটু করে বাড়তে থাকে। সব মিলিয়ে একটি আমবাগান চার থেকে পাঁচবার বিক্রি বা হাত বদল হয়।
এতে সুস্বাদু-রসালো আম বাজারের ঝুড়িতে ওঠা ও বিক্রি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার কারবার হয় রাজশাহী অঞ্চলে। তাই মৌসুমটির জন্য বছর ধরে শ্রম দেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, উত্তরাঞ্চলের জেলা শহরগুলোর মধ্যে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁয়ের প্রায় সব এলাকাতেই এখন নতুন নতুন আমবাগান হয়েছে। প্রতি বছরই বাগানের সংখ্যা বাড়ছে। তবে নতুন আমবাগানগুলো প্রায়ই বনেদি জাতের। বিশেষ করে নিয়মিত জাত গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ক্ষিরসাপাত ও আশ্বিনা জাতের আমগাছই বেশি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালী বাংলানিউজকে বলেন, চাষিরা এখন আমগাছের নিয়মিত পরিচর্যা এবং যত্ন নেন। তাই প্রতিবছরই ভালো ফলন হয়। হুট করে গরম চলে এলেও আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলেই রয়েছে। রাতের হালকা হালকা শীত আমের উপকারী। তবে এই মাসে হালকা বৃষ্টি হলে তা আরও ভালো হবে। কারণ এতে আমের গুটি বেশি টিকবে।
তিনি বলেন, ধান-চাল বা অন্য কয়েকটি ফসলের মতো আম উৎপাদনের কোনো লক্ষ্যমাত্রা অধিদফতরের কাছে থাকে না। তবে রাজশাহীতে গত বছর ১৬ হাজার ৫৮৩ হেক্টর জমিতে আমের বাগান ছিল। কিন্তু বিভিন্ন উপজেলায় প্রতি বছরই নতুন বাগান হচ্ছে। তাই এবার আমের আবাদও কিছুটা বাড়বে।
আগামী মে মাসের শেষ দিক থেকে রাজশাহীর বাজারে আম উঠতে শুরু করবে। প্রথমেই উঠবে জাত আম গোপালভোগ, রানীপছন্দ ও ক্ষিরসাপাত আম। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই ল্যাংড়া, লকনা, লক্ষণভোগ, দুধসর, আম্রপালি, মোহনভোগসহ বিভিন্ন জাতের আমে ভরে উঠবে। এরপর চলতি মৌসুমের আকর্ষণীয় ফল ফজলি এবং সবশেষ আশ্বিনা আম উঠবে বাজারের ঝুড়িতে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০১৭
এসএস/এএ