বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পঞ্চম ধাপের স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম চলছে। কয়েকদিন ধরে সরেজমিন বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, প্রবীণ বা সিনিয়র নাগরিকদের জন্য রাখা হয়নি কোনো আলাদা লাইন।
উত্তর কাফরুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, লম্বা লাইনের লেজের দিকে দাঁড়িয়ে আছেন সুফিয়া বেগম। তার জন্ম ১৯৫৪ সালে। ষাট অতিক্রম করা এই নারী ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকেও ২০ হাত পরিমাণ জায়গা এগোতে পারেননি। স্মার্টকার্ড নেওয়ার আগ্রহটা এই প্রবীণের দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই যে ফিকে হয়ে গেছে, তা তাঁর করুণ মুখ দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই নাকি বয়স্কদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এতো বড় কার্যক্রম আমাদের মতো বয়স্কদের জন্য একটু আলাদা লাইনের ব্যবস্থা করলে কি সমস্যা হয়?’ এই প্রশ্ন ছুঁড়ে তিনি আক্ষেপ করে এ-ও বলেন, ‘যারা এমন সিদ্ধান্ত নেন, তাদের কি গুরুজন নেই?’
১৯৪৫ সালে জন্ম কাফরুলের ভোটার জাহানারা বেগমের। ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে আর যেন পারছিলেন না। অনেকটা হাঁপিয়ে উঠছিলেন। এই অবস্থায় পুত্রবধূর সহায়তায় কোথাও একটু বসার জায়গা খুঁজছিলেন। সত্তরোর্ধ্ব এই সিনিয়র সিটিজেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের জন্য তো কোনো ব্যবস্থা নেই! মহিলা-পুরুষের আলাদা লাইন। আমরা কি পারি সেই লাইনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে স্লিপ নিয়ে ভেতরে যেতে?’
মগবাজারের শাহ নূরী মডেল বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়েও গত বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) দেখা গেছে উপচেপড়া ভিড়। সেখানে নারী-পুরুষের লাইন সাপের লেজের মত স্কুলের মাঠজুড়ে পেঁচিয়ে গেছে। এর মধ্যেই দুই ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন রহিম উদ্দীন, সোলায়মান রহমানের মত প্রবীণরা।
স্মার্টকার্ড নিতে হলে, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে গিয়ে প্রথমেই লাইনে দাঁড়িয়ে একটি স্লিপ সংগ্রহ করতে হয়। যে স্লিপে লেখা থাকে কোন বুথে তার কার্ড দেওয়া হবে। এরপর সেই বুথে গিয়ে অপারেটরকে স্লিপ দিলেই তিনি দশ আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের ইম্প্রেশন নিয়ে স্মার্টকার্ড সরবরাহ করেন। কিন্তু ওই স্লিপ পেতেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যেখানে অপেক্ষায় থাকতে হয় প্রবীণ, অসুস্থ কিংবা গর্ভবতী মায়েদেরও।
স্মার্টকার্ড বিতরণের প্রথম দিকে ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নির্দেশ দিয়েছিলেন, প্রবীণদের জন্য আলাদা হেল্প ডেস্ক করার জন্য। তিনি সেদিন বলেছিলেন, স্মার্টকার্ড বিতরণে প্রবীণদের জন্য আলাদা হেল্প ডেস্ক করতে বলা হয়েছে। উনাদের রাস্তায় যাতে না দাঁড়াতে হয়। আর যারা প্রতিবন্ধী, তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় হলেও সত্যি, প্রবীণদের এখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেই সেবা নিতে হচ্ছে।
তবে স্মার্টকার্ড বিতরণকেন্দ্রের অপারেটররা দাবি করছেন, বুথে প্রবীণ, অসুস্থ বা গর্ভবতী মায়েদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চোখের প্রতিচ্ছবি আর দশ আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে দ্রুত কার্ড সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তার ছিটেফোঁটা প্রমাণও মেলেনি।
‘বুথে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে কিন্তু স্লিপের জন্য তো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘন্টাখানেকেরও বেশি সময়। তাহলে কেন তাদের জন্য আলাদা লাইনের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না?’-- এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তর কাফরুলের ওই কেন্দ্রটির অপারেটর মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘লাইনে যদি তারা আগে যেতে চান, নিশ্চয় কেউ না করবেন না। আবার লাইনের অপারেটরকে বললেও তিনি স্লিপ আগেই দেবেন। ’
এভাবেই দায়সারা জবাব দেন তিনি।
এদিকে সেবাগ্রহীতারা বলছেন, প্রবীণ বা অসুস্থদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা দেওয়া হবে-- কোথাও এমন কোনো নির্দেশনা নেই, ঘোষণা নেই বা কোনো প্ল্যাকার্ড বা ফেস্টুন নেই। তাই তারাও দাঁড়িয়ে থেকে থেকে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মানুষ তো জানেই না যে, ইসির এমন একটি নির্দেশনা রয়েছে। আবার সেই নির্দেশনা থাকলেও মানাও হচ্ছে না। তাই প্রবীণ বা বয়স্কদের জন্য কি কি সেবা রয়েছে, কেন্দ্রের দেয়ালে বা লক্ষ্যযোগ্য স্থানে লিখিত অবস্থায় থাকা উচিত। ডিসপ্লে করা উচিত।
এসব বিষয় নিয়ে ইসি সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ‘লাইনে যারা আছেন, তাদেরও উচিত প্রবীণ বা অসুস্থদের কিংবা প্রতিবন্ধীদের জায়গা করে দেওয়া। এ বিষয়ে আমরা কার্যকরী ব্যবস্থা নেব। ’
অন্যদিকে এখনো প্রচারের যে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে, একই কেন্দ্রে রহিমা খাতুনসহ কয়েকজনকে দেখেই তা বোঝা গেল। আগের কার্ড হারিয়ে যাওয়ায় ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার কেবল রশিদ নিয়ে এসেছেন তারা স্মার্টকার্ড সংগ্রহ করতে। অথচ ইসির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, পুরনো এনআইডি হারিয়ে গেলে নতুন করে আবার তা তুলে নিয়ে স্মার্টকার্ড বিতরণকেন্দ্রে আসতে হবে।
২০১৬ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতিকে স্মার্টকার্ড বিতরণের মাধ্যমে এ কার্যক্রমটি উদ্বোধন করেন।
৩ অক্টোবর থেকে ঢাকায় নাগরিকদের মধ্যে কার্ড বিতরণে যায় ইসি। বর্তমানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৫, ১৬, ১৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৩৫ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের কার্ড বিতরণ চলছে। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৮, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটারদের এই কার্ড দেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় শেষ হলে ধারাবাহিকভাবে বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় এ উন্নতমানের কার্ড বিতরণে যাবে সংস্থাটি।
আগের নিউজের লিংক:
*** বয়স্কদের ন্যূনতম সম্মান দিলেন না ‘উপ-সচিব’ শাহ আলম
*** অবশেষে বয়স্কদের সম্মান দেওয়ার নির্দেশনা সিইসির
*** স্মার্টকার্ড বিতরণে প্রবীণদের জন্য আলাদা হেল্প ডেস্ক
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৭
ইইউডি/জেএম