ঢাকা, সোমবার, ২০ মাঘ ১৪৩১, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

বিদেশে চাকরির নামে বিক্রি হয়ে যাওয়াদের দু:সহ স্মৃতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৭
বিদেশে চাকরির নামে বিক্রি হয়ে যাওয়াদের দু:সহ স্মৃতি দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত, সর্বস্বান্ত হয়ে দেশে ফিরে আসা তরুণ-তরুণীরা/ছবি: দীপু মালাকার

ঢাকা: দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে বিদেশযাত্রা। ভেবেছিলেন, সহায় সম্বল বিক্রি করে হলেও কোনোমতে ভিনদেশে পাড়ি জমানো গেলে বদলে যাবে ভাগ্য। কিন্তু ঘোর কাটতে সময় লাগেনি বগুড়ার শাহীনুর বেগমের। আসলে সেদিন মিথ্যে প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে দালালচক্রের মাধ্যমে ভিনদেশে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

তিনি শুধু সর্বস্বান্ত হয়েই দেশে ফেরেননি, ফিরেছেন কলঙ্ককে সঙ্গী করে। স্বামী ও সমাজের কাছ থেকে বিতাড়িত দিশেহারা শাহীনুরের প্রশ্ন, ‘দুই সন্তান নিয়ে এখন কীভাবে বাঁচব আমি?’

শুধু শাহীনুর নন, এভাবে ফাঁদে পড়ে প্রতারিত, সর্বস্বান্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন বিউটি বেগম, মাহবুবসহ অসংখ্য তরুণ-তরুণী।

শনিবার (১১ মার্চ) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক সেমিনারে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই নিজেদের জীবনের নির্মম পরিহাসের কথা শোনাচ্ছিলেন তারা।

‘নিরাপদ অভিবাসন এবং মানবপাচার প্রতিরোধ’ শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

শাহীনুর বেগম জানান, সংসারের প্রতি নেশাগ্রস্ত স্বামীর অবহেলা আর দুই সন্তান নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটছিলো তার। জীবনের  এ দুর্দশা থেকে বাঁচতে উপায় খুঁজছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পরিচিত এক ভাইয়ের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, মাত্র লাখখানেক টাকায় দুবাইতে গৃহকর্মী নেওয়া হচ্ছে। সুন্দর পরিবেশ ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা শুনে রাজি হয়ে যান তিনি। পরে, ২০১৪ এর শেষের দিকে ৯০ হাজার টাকার বিনিময়ে দুই সন্তানকে দেশে রেখেই বিদেশযাত্রা করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘ভাল বেতন দেওয়া হবে বলে আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে বেতন তো দূরের কথা, দু’বেলা আমাকে খেতে দেওয়া হতো না, প্রতিনিয়ত মারধর করা হতো। ’

তাকে কয়েকবার বিক্রি করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাকে প্রথম বিক্রি করা হয় ঢাকায়। আমার ফ্লাইট হওয়ার কথা ছিল ঢাকা থেকে। কিন্তু কোনো এক কারণে আমাকে বলা হলো ফ্লাইট হবে চট্টগ্রাম থেকে। সেখান থেকে আমাকে প্রথম পাঠানো হয় সিরিয়ায়। সিরিয়ায় কয়েকদিন রাখার পর পাঠানো হয় লেবাননে। সেখানে আমাকে একটি বাড়িতে বিক্রি করা হয়। এর আগে যারা আমাকে সেখানে রিসিভ করেছিলো তারা আমার পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে যায়। সেখানে এক মাসের মতো রাখা হয় আমাকে। সেই বাড়িতে ঘরের কাজ করার পাশাপাশি মালিক আমাকে প্রায়ই শারীরিক নির‌্যাতন করতো। একমাস পর তারা আমাকে দুবাইয়ের একটি অফিসে পাঠায়।

‘দুবাইয়ের সেই অফিস থেকে আমাকে এক শেখের বাড়িতে কাজে পাঠানো হয়। সেখানে শেখ ও বন্ধুরা আমাকে প্রায়ই শারীরিক নির‌্যাতন করতো। কখনও খুব মারধর করতো। কারেন্টের তার দিয়ে চাবুক বানিয়ে আমাকে মারতো তারা। সেখানে এ দুই মাসে আমাকে বেতন দেওয়া হয়নি। মালিকের কাছে বেতন চাইলে আমাকে বলতো, তিনি আমাকে কিনে এনেছেন। তারপর সে মালিক আমাকে আগের ওই অফিসে পাঠিয়ে দেয়। ওই অফিসের লোকদের আমি যখন বলি আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিতে, তখন তারা আমাকে টাকা দিতে বলে।

এর কিছুদিনের মধ্যে আমাকে আরেকটি অফিসে পাঠায় তারা। সেখানে গিয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম, এই অফিস থেকে আমাকে দেশে পাঠানো হবে। পরে জানতে পারলাম সেটি পতিতালয়। এক সময় আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি।

‘২০১৫ সালের শুরুর দিকে আমি বাড়িতে মাকে ফোন দিই। মা প্রথমে দালালের কাছে গেলে ওই দালাল দেশে ফেরত আনতে টাকা চায়। পরে মা র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। র‌্যাব আমাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করে। অসুস্থ অবস্থায় র‌্যাব দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। পরে আমি জানতে পারি আমার একটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে।

লেবানন-ফেরত বিউটি বেগম বলেন, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে লেবানন পাঠানো হয়। সেখানে যাওয়ার পর আমাকে একটি গাড়িতে করে কাজে পাঠানো হয়। যে বাসায় কাজ পাঠানো হয় সেই বাসার সব কাজ আমাকে দিয়ে করানো হতো। নিজেদের খাওয়ার পর খাবার উদ্বৃত্ত থাকলেই কেবল তারা আমাকে খেতে দিতো। বাড়ির বাইরে যাবার সময় তারা বাইরে তালা লাগিয়ে যেতো। প্রথম দুই মাস কাজ করার পর যখন বেতন চাই তখন তারা আমার ওপর নির্যাতন শুরু করে।

চার মাস পর মালিকের স্ত্রীর জানায়, আমাকে কিনে আনা হয়েছে। পাঁচ মাস পর তারা আমাকে বাড়িতে ফোন করার সুযোগ দেয়। পরে বাড়িতে আমার বিপদের কথা জানালে র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাড়ির লোকজন আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন।

মালয়েশিয়া-ফেরত মাহবুব জানান, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মালেয়শিয়া যান তিনি। এয়ারপোর্ট থেকে নামার পরই দুটি মাইক্রোবাস আসে। তাকে মাইক্রোবাসে তুলে একটি জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আগে থেকেই অনেক বাংলাদেশিকে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সঙ্গে থাকা চার হাজার রিংগিত শুরুতেই নিয়ে যায়। পরে মুক্তিপণ হিসেবে চাওয়া হয় আরও একলাখ টাকা। বিষয়টি বাড়িতে জানালে র‌্যাব দেশের ভেতরে সক্রিয় এই প্রতারক চক্রের কয়েকজনকে পাকড়াও করে আমাকে ফেরত আনার ব্যবস্থা করে।

সেমিনারে জানানো হয়, এ পর‌্যন্ত পাচার হওয়া ১৫২ জনকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে র‌্যাব। সেমিনার শেষে এদের ১০ জনকে ১ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৭
পিএম/ওএইচ/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।