স্বাধীনতার ঠিক পরের চিত্র এটা। গ্রামটি এখন যমুনার পেটে।
সাজানো গোছানো সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে সর্বগ্রাসী যমুনা। কালের আবর্তে নিত্যনতুন জনপদ গিলে খেয়েছে। যমুনার মরণ ছোবলে শতশত মানুষ গৃহহারা হয়েছেন।
বসতভিটা, সহায় সম্পদ হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন তারা। চোখের জল ফেলতে ফেলতে পৈত্রিক বসতভিটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। শত চেষ্টা করেও আঁকড়ে রাখতে পারেননি পূর্ব পুরুষের সামান্য স্মৃতিচিহৃ।
বন্যায় ঠাঁই নিতে হয় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ বা অন্যের উঁচু জায়গা জমিতে। পানি নেমে গেলে জীবিকার সন্ধানে ছুটে যান চরাঞ্চলে। চরের মাটিতে অনেকে ফলান রকমারি ফসল। অনেকে করেন দিনমজুরের কাজ। যে যেভাবে পারেন সংসারের অভাবে ঘুচানোর চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে নারীরাও এগিয়ে চলেন সমানতালে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার যমুনার চরাঞ্চল ঘুরে সেখানকার নারী-পুরুষের বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর লড়াই সংগ্রামের চিত্র ওঠে আসে।
আবুল কাশেম, মমতাজ উদ্দিন, লুৎফর রহমান, নান্টু মিয়া। প্রত্যেকের বয়স ৬৫-৭০ বছরের মধ্যে। দীর্ঘ ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কোন রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই বানিয়ে বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করছেন।
তারা বাংলানিউজকে জানান, যমুনার ভাঙনে বহু বছর আগেই নিঃস্ব হয়েছে শতশত পরিবার। অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করেই টিকে আছেন চরাঞ্চলের মানুষ। তবে চিত্রটা পাল্টে গেছে অনেক। আগ্রাসী যমুনা তার বিশাল বুক উজার করে দিয়েছে এসব অভাবী মানুষের জন্য। প্রত্যেক বছর বন্যায় পলি মাটি জমে বালুচরগুলো উর্বর হয়ে পরিণত হয়েছে আবাদি জমিতে।
চরাঞ্চলের বিশাল বুকজুড়ে মরিচ, ভুট্টা, ধান, পাট, আখ, হরেক পদে ডাল, সরিষা, ‘গুপ্তধন’ বলে পরিচিত বাদাম, টমেটো, নানা ধরনের সবজি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু, কলা, ধনিয়াসহ বিভিন্ন জাতের ফসল চাষ করে অনেক নারী-পুরুষ স্বচ্ছলতা এনেছেন সংসারে। অনেকে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন বলেও জানান তারা।
হালিমা বেগম, আফরোজা খাতুন, রমেজা বিবি, জয়নাল আবেদীন, চাঁন মিয়াসহ চরের একাধিক ব্যক্তি বাংলানিউজকে বলেন, প্রত্যেক বর্ষায় যমুনা হিংস্র রূপ নেয়। বসতভিটা কেড়ে নেয়। তবে উৎপাদিত রকমারি ফলস চরাঞ্চলের মানুষগুলোর হারানো শক্তি অনেকটাই ফিরিয়ে দিয়েছে। জুগিয়েছে অফুরন্ত সাহস।
তারা আরো বলেন, যমুনার পানি নেমে গেলেই মৌসুম ভিত্তিক ফসল চাষ শুরু করি। বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলাই। বাজারে বিক্রি করি। বাড়তি আয়ে প্রত্যেক সংসারে স্বামী-স্ত্রী মিলে এ কাজে শ্রম দেই। আবার অনেকে নিজের কাজের পাশাপাশি শ্রম বিক্রি করি।
চরের এসব ব্যক্তি জানান, চরাঞ্চলের জমিতে ফসল ফলাতে নানা সমস্যা রয়েছে। এরমধ্যে সেচ ও জমি প্রস্তুতির বিষয়টি অন্যতম। এছাড়া কীটনাশক ও স্প্রে মেশিনের সমস্যাও রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে একদিন হয়তো চরের মানুষের জীবনযাত্রার মানেও ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপতরের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের হর্টিকালচার সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর কৃষিবিদ আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, চরাঞ্চলের মানুষের যমুনার সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ করে জীবনযাপন করতে হয়। তবে তাদের সে অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।
প্রত্যেক বছর শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকেই তারা মৌসুম ভিত্তিক নানা ধরনের ফসল চাষে নামেন। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আবাদি জমির পরিমাণ বাড়িয়ে নিচ্ছেন তারা। উৎপাদন ভাল হচ্ছে। দামও ভাল পাচ্ছেন। এরপরও তাদের বেশ কিছু সমস্যা হচ্ছে।
সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে কৃষি বিভাগ কাজ করছে বলেও যোগ করেন কৃষিবিদ আব্দুর রহিম।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৭
এমবিএইচ/জেডএম