দুপুর ২টার দিকেই শহরে বিভিন্ন পয়েন্টে পেট্রোল পাঠিয়ে দেয় পুলিশ কন্ট্রোল রুম। আমি ছিলাম পুলিশ লাইন্সেই।
কথাগুলো বলে একটু দম নিলেন কাঞ্চন আলী মিয়া।
১৯৭১’র ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার সূচনা পর্বে পুলিশের যে ক’জন সদস্য সামান্য থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টার ও ভারি মেশিনগানের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাদেরই একজন।
সে রাতে হানাদারদের মেশিনগানের গোলায় ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল সবকটি পুলিশ ব্যারাক। অনেক পুলিশ সদস্য পড়ে থাকেন লাশ হয়ে। তবে কাঞ্চন আলীরা মাথা নত করেননি।
রাজারবাগ থেকেই শুরু হয় প্রথম প্রতিরোধ, প্রথম মুক্তির সংগ্রাম। সে সংগ্রামের এক গর্বিত যোদ্ধা কনস্টেবল নম্বর ৫২৩১ কাঞ্চন আলী মিয়া।
রাজধানীর মগবাজারের নয়াটোলায় সরকারি খাসজমিতে টিনের একচালা ছোট্ট একটা দালানবাড়িতে থাকেন কাঞ্চন। সেখানেই কথা হয় তার সাথে।
কাঞ্চন আলী বলছিলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ডাকের পর থেকে তিনিও কিন্তু মনে মনে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ছিলেন। কিন্তু দিনটি যে এত তারাতারি এসে যাবে ভাবেননি। বললেন, পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন বিহারী বা পশ্চিম পাকিস্তানের। এ অফিসার ও সুবেদারদের আচরণে অনুমান করছিলাম একটা ভয়াবহ সময় ঘনিয়ে আসছে। আর দ্রুতই তা এসে গেলো।
‘ঢাকার বাইরে থেকে অনেক পুলিশকে ক্লোজড করে রাজারবাগে নিয়েআসা হয়। এতেও সন্দেহ বাড়ে আমাদের। ’
সেই দিনটির কথা বলুন, বাংলানিউজের এমন আগ্রহে কাঞ্চন আলী একটি দৃশ্য তুলে ধরেন তার স্মৃতি থেকে। বলেন, বিকেল তিনটার দিকে একটা খবর আসে রাতে পাকহানাদার বাহিনী রাজারবাগ আক্রমন করবে। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালই এই খবরটি পাঠিয়েছেন বলেও তখন শুনতে পাই।
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যারা টহল দিচ্ছিলো তাদের কাছ থেকেও ওয়ারলেস তথ্য আসে শহরের অবস্থা থমথমে। চারিদিকে আতঙ্ক।
সন্ধ্যা নাগাদ আরো মজবুত খবর পাই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সেই হামলা হবে। শুরু হয় কানাঘুষা। আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কথা-বার্তা বলি। আর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই, ছেড়ে দেওয়া হবে না। প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।
সে অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকি। ইউনিফর্ম পরে নেই সবাই, বলেন কাঞ্চন আলী।
রাত ১০টার দিকে খবর আসে সেনাবাহিনীর একটা বড় কনভয় ঢুকেছে শহরে।
তখন আমাদের আর কোনও পথ নেই। আমরা সকল পুলিশ সদস্য মিলে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে ফেলি। এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করি। যার বেশিরভাগই ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল।
দ্রুত আমরা পুলিশ লাইন্সের বিভিন্ন অংশে ভাগ হয়ে অবস্থান নেই। বাংকারও খোঁড়া হয় কয়েকটি। আমি ছিলাম মাঠের দক্ষিণ দিকে।
এরপর যা কিছু তা যুদ্ধের বর্ণনা। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ।
কাঞ্চন আলী বলেন, রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পাকবাহিনীর প্রথম একটি দল পায়ে হেঁটে মার্চ করে আসতে থাকে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল তাদের। পায়ে হাঁটা দলের পেছনে ছিল গাড়িবহর এবং এরপর ট্যাংকসহ সাঁজোয়া যান। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের গুলির রেঞ্জের মধ্যে চলে আসে হানাদারেরা।
কাঞ্চণ বলেন, ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগে আমরাই প্রথম ফায়ার ওপেন করি। তুমুল গোলাগুলি চলে আধাঘন্টা। আমরা থ্রি নট থ্রি দিয়েই প্রতিরোধ করি। ওরা ভাবতেও পারেনি, এমন প্রতিরোধের মুখে পড়বে।
অল্প সময়ের মধ্যেই মার্চ করা বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আর পেছন হটে।
এরপর গাড়িবহর ও সাজোয়া যান সামনে আসতে থাকে। এতো ভারি অস্ত্রের সামনে প্রতিরোধ করা আর সম্ভব আর হয়না পুলিশ সদস্যদের, বলেন কাঞ্চন।
এরপর চলতে থাকে হত্যাযজ্ঞ। হানাদারেরা সার্চ লাইট মেরে পুরো পুলিশ লাইন্স আলোকিত করে আমাদের খুঁজতে থাকে। বৃষ্টির মতো গুলি চলতে থাকে। পাকিস্তান রিজার্ভড ফোর্সেস (পিআরএফ)–র টিনশেডের ব্যরাকে আগুন লাগিয়ে দেয়। ট্যাংক নিয়ে দক্ষিণ পূর্ব কোনার ভবনে গোলা ছুঁড়লে তিন তলা ব্যারাকেও আগুন লেগে যায়।
যুদ্ধ চালাতে চালাতেই আমরা নিজেদের প্রত্যাহার করে পিছু হটতে থাকি। আমি পেছন দিক দিয়ে চামেলীবাগ চলে যাই। আমার সঙ্গে ময়মনসিংহের একজন ছিলেন। নাম আবুল কালাম আজাদ।
আধা ঘণ্টার মতো সরাসরি প্রতিরোধ করলেও রাত ৩টা পর্যন্ত থেমে থেকে সে যুদ্ধ চলে। স্বল্প শক্তি নিয়ে এতটা সময় প্রতিরোধ করার পেছনে ছিলো আরও একটি উদ্দেশ্য। পুলিশ লাইন্সের অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলো নিয়ে যাতে কিছু পুলিশ সদস্য বের হয়ে যেতে পারে। সেটা ছিলো ভবিষ্যত যুদ্ধেরই কৌশল।
কতজন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন সে পরিসংখ্যান কাঞ্চন আলীর পক্ষে সে রাতে জানা সম্ভব ছিলো না। তিনি বলেন, সে যুদ্ধে পুলিশের অনেক সদস্য নিহত হন। তবে আমাদের হাতে হানাদার সৈন্যরাও কম মরেনি।
তবে বিহারী পুলিশ সদস্যদের সাহায্য না পেলে হানাদার বাহিনী এতো বাঙ্গালি পুলিশ হত্যা করতো পারতেন না বলেও মনে করেন তিনি।
বলেন, 'ওরা না থাকলে আমাদের গোলাবারুদ পুরোপুরি নিয়ে সরে যাওয়ার সুযোগ থাকতো। '
সে রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস দখল করে নেয় হানাদাররা। বন্দি হন প্রায় দেড়শ বাঙ্গালী পুলিশ।
‘শুনেছি তাদের ওপর বেশ নির্যাতন চলেছে,’ বলেন সহযোদ্ধাদের ব্যথায় এখনো ব্যথিত এই মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ কনস্টেবল।
২৫ মার্চের সে রাতের পরে কি হলো? বাংলানিউজের এমন প্রশ্নে কাঞ্চন আলী বলেন, ২৬ মার্চ দুপুরের পর থেকে পাকিস্তানি বেতার থেকে একটা ঘোষণা প্রচার হতে থাকে-সেনাবাহিনরীর যে কোন অফিসার যেকোন সময় যে কোন স্থানে যে কারো তল্লাশি চালাতে পারবে।
‘এই সংবাদ শুনে আতঙ্ক বাড়ে। যেহেতু আমরা ব্যারিকেডের মধ্যে ছিলাম, তাই নিরাপদ ছিলাম না। সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসাররাও তল্লাশি করবে। তার মানে খুঁজে খুঁজে আমাদের মেরে ফেলবে।
জানালেন, শান্তিনগরের চৌরাস্তা পার হয়ে স্বিদ্ধেশ্বরীর ভেতর দিয়ে রমনা থানার পেছনে ইস্পাহানি চা কোম্পানির একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠেন কাঞ্চন। সেখানে প্রায় ৩০০ পুলিশ সদস্য জড়ো হয়েছিলেন।
‘২৭ মার্চ কারফিউ ভাঙ্গলে আমি সাধারণের বেশে রাজারবাগের দিকে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি রক্ত আর রক্ত। ’ ‘এক পুলিশসদস্যের লাশ পড়ে থাকার দৃশ্য আজও চোখে ভাসে, বুকের বাম পার্শ্বে গুলির চিহ্ন। পেছন থেকে সে গুলি বেরিয়ে গেছে। মাঠের দক্ষিণ পাশে একটি স্লাবের ওপর পড়েছিল সে লাশ। বুকের নেমপ্লেটে লেখা ছিল- ঢাকা পুলিশ, আব্দুল মজিদ। '
সহযোদ্ধার সেই মৃতমুখ স্মরণ করে চোখ ছলছল করে উঠতে থাকে কাঞ্চন আলীর।
২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণার যে কথা ও দাবি উঠেছে, সে দাবি এই কাঞ্চন আলীরও। তিনি বলেন, এমন একটি রাত বিশ্বে গণহত্যার জঘন্যতম উদাহরণ।
বাংলাদেশ সময় ১১৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৭
এমএমকে