জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট অফিসের কর্মচারী রাম বিহারী দাসের ছেলে রবীন্দ্র মোহন দাশ তৎকালীন সময়ে নিউ পল্টন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ২৫ মার্চের গণহত্যার সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা তুলে ধরেন বাংলানিউজের কাছে।
রবীন্দ্র মোহন বলেন, ২৫ মার্চ সন্ধ্যে থেকেই একটা থমথমে ভাব চলে আসে। পাকিস্তানিরা যে এভাবে আক্রমণ করবে, সেটা জানা ছিল না। তবে পুলিশ রাস্তায় নামবে এবং হরতাল ভণ্ডুল করার চেষ্টা করবে, সেটা সবাই জানতো।
রবীন্দ্র মোহনের বড় ভাই ফনীন্দ্রমোহনের বন্ধু সেলিম চাকরি করতেন বুয়েটে। তিনি এসে সবাইকে বাসায় থাকতে বললেন এবং পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে বলে সতর্ক করে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকেই যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্র মোহন বলেন, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেই এক সপ্তাহ। ক্যাম্পাসে তখন জায়গায় জায়গায় ট্রেনিং চলতো। রেফটিং আর ক্রলিং সেখানো হতো। ২৬ তারিখে আরেকটা ট্রেনিংয়ের পর আমাদের ক্যাম্পে পাঠানোর নির্দেশ ছিল। সাদা কাপড়ের ওপর লাল কাপড়ে লেখা গণবাহিনীর একটা ব্যাজ দেয়া হয় আমাদের। আমি অবশ্য বলেছিলাম, আজকেই বলে দেন কোথায় যেতে হবে। ট্রেইনাররা বলেন, এটা গোপন। কালই টোকেন দেয়া হবে। তখন নির্দিস্ট জায়গায় যেতে হবে। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টাকে আনন্দের মধ্যে রাখি। তখন আমি বেশিরভাগ সময়ই হাফপ্যান্ট পড়তাম। সবাই আদর করতো। ছোট ছিলাম বলে সবাই আদর করতেন। ’
অপারেশন সার্চলেইট শুরুর বিষয়ে তিনি বলেন, আমি পড়ছিলাম। তখন ভয়েস অব আমেরিকা এবং বিবিসির সংবাদ রেডিওতে শুনতাম আমরা সবাই মিলে। আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিবিসির খবর শেষ হয়ে ভয়েস অব আমেরিকার খবর চলছিল। এরই মধ্যে রাজারবাগের থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসছিল। ’
‘তখন এগারোটা বা সাড়ে এগারোটা। বড় ভাই বললো, হয়তো রাজারবাগে গোলাগুলি হচ্ছে, পুলিশে পুলিশে লেগে গিয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরেই পিলখানায় শুরু হয়। গোলাগুলির শব্দ বাড়তে থাকে। জগন্নাথ হলের মাঠের পূর্ব দিকের দেয়ালের বাইরে রাস্তাটা তখন সরু ছিল। সেটাকে সংস্কার করার জন্যে ইট-পাথর এনে রাখা হয়েছিল। পাথরের ওপর দিয়ে খচ খচ করে আওয়াজ হচ্ছিল। ঘর থেকে বের হয়ে দেয়ালের ওপর দিয়ে দেখি কয়েক ব্যাটেলিয়ন সৈন্য হল ঘেরাও করছে। দ্রুত ঘরে ফিরে আসি। এর মধ্যেই ডিনামাইটের মতো আওয়াজ হলো এবং একটা সার্চ লাইট জ্বলে উঠলো। পুরো জগন্নাথ হল আলোকিত হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গেই ব্ল্যাক আউট। হলের কারেন্ট চলে গেলো। এরপর ঠা.. ঠা.. ঠুস.. ঠুস.. গুলির শব্দ। সেই গুলি শিলাবৃষ্টিকেও হার মানাচ্ছিল। ’
রবীন্দ্র মোহনদের ছিল টিনের ঘর। টিন ফুটো হয়ে গুলি ঘরে ঢুকছিলো। সে, তার বড় দা, বৌদি আর ভাতিজা সকলেই হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নিচে চলে যান।
রবীন্দ্র মোহন বলেন, ‘সেই গুলি চলছিল। মারে বাবারে, বাঁচারে.. হাহাকার শোনা যাচ্ছিল। ফজরের আজানের কিছু সময় আগে দিয়ে ঘরে দিলো আগুন। আমাদের কর্মচারীদের ঘর ছিল ৬ টা। বহিরাগতদের ঘর ছিল ২০ টা। আর ছাত্রদের একটা টিনশেড ছিল, সেখানে দুই থেকে আড়াইশ ছাত্র থাকতো। এক দিক থেকে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে আজান দিলে গোলাগুলি থামে। ’
গাভী পালতেন স্কুল ছাত্র রবীন্দ্র মোহন। ছাত্রদের কাছে এক সের দুধ বিক্রি করতেন এক টাকায়। এই সম্পদটুকু রাখতে চাইলেন তিনি। বলেন, ‘মনে হইলো গরুগুলা ঘরে পুড়ে মরবে! এগুলোকে বের করে দেই। দেখি গরু আর সামনে আগ বাড়ে না। আমি বুঝতে পারিনি কালো পিঁপড়ার ঝাকের মতো আর্মি সামনে আছে। ’
‘ওরা তখন ট্যাংক ঢুকায়। শহীদ মিনারে ট্যাংকের গোলা মারে। নর্থ বিল্ডিংয়ের একটা গার্ড রুমে দারোয়ান ছিল দুথিরাম মন্ডল। তার ওপর গোলা পড়লে অর্ধেক শরীর জ্বলে যায়। পরে শহীদ হন তিনি। ’
তিনি বলিই চলেন, ‘আমাদের ঘরের পাশে আরেকটা গার্ড শিবপদ কুড়িকে ধরে নিয়ে আসে এবং রাইফেল দিয়ে মারতে থাকে। মার সহ্য করতে না পেরে আমার বড় ভাইয়ের নাম ধরে ডাক দেয়, ফনি দা ফনি দা আমাকে মেরে ফেললো, বাঁচান। ’
সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাঁশের দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পাক সেনারা। ফনীভূষণ ছোট ভাইকে নিয়ে বের হয়ে আসেন। নাহলে হানাদারেরা ব্রাশ ফায়ার চালাতে পারেন। ফনীভূষণ ছিলেন বয়স্ক। ইংরেজ সময়ে আসামে টেলিফোন লাইনে চাকরি করতেন। অহমিয়া আর উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
ফনীভূষণকে বেলুচি সৈন্যরা গালি দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘... তুমারা কোন ব্রাদার হায়?’ উত্তর দেন, ‘স্যার হামতো সুইপার হায়, সুইপার। হাম ড্রেন মে বুরুজ মারতা হ্যায়। ’ ফনীভূষণকে টেনে নিয়ে যায়। বুটের লাথির সঙ্গে চলছিল রাইফেলের বাটের আঘাত।
রবীন্দ্র মোহন বলেন, ‘দাদা’র কাছে হানাদারেরা জিজ্ঞাসা করে, ছাত্র কিদার হ্যায় আর মালাউন কিদার হ্যায়? ওরা জানতো এটা হিন্দুদের হল। দাদা বললেন, ছাত্রতো নাহি হেয়ি, সব চালা গিয়া আর মালাউনতো চল গেয়া। ’
‘ওদের ভাষায় কথা বলাতে দাদাকে ছেড়ে দেয়। আজান যদি আগুনের লাগানোর আগে দিতো, হয়তো আর আগুন দিতো না। ওরা জানতো এখানে সব কাফের থাকে। তবে ঢাকায় এতো আজান শুনে তারা একটু ভড়কে যায়। ’
‘তখন ভোর হয় হয়। এবার লাশ স্তূপ করার পালা। ভেতরে তখন এখানে ওখানে লাশ পড়ে আছে। সকালে যাদের জীবিত পাওয়া যায়, তাদের আটক করে। আমিসহ মোট ৩১ জনকে আটক করে হানাদারেরা। তখন ঢাবির প্রধান প্রকৌশলী দবিরউদ্দিন মৃধা সাহেব এই হলে গরু পালতেন দুইজন মিস্ত্রী দিয়ে। মাঠের পূর্ব পাশের কোণায় ওই ঘরটার মধ্যে আমাদের ৩১ জনকে আটকায়। ঘরের মধ্যে দাগ দিয়ে বলে, বানচোতকা লোক, দাগ পারগায়াতো, তুম লোক মার যায়া। ’
নিজের মানসিক অবস্থার বর্ণনা করে রবীন্দ্র বলেন, ‘তখন আমরা জীবন্মৃত। কারো সঙ্গে কারো কথা নেই। মৃত্যু অবধারিত। কিছুক্ষণ পর ১০-১২ জন হানাদার এসে ১৫ জনকে বেছে নিয়ে যায়। চর্তুদিকে যে লাশগুলো ছিলো সেগুলো টানায় তাদের দিয়ে। মাঠের লং জাম্প দেয়ার জায়গাটায় সব লাশ এনে স্তূপ করা হয়। এরপর লাশ টানা ১৫ জনকে সেখানে লাইন ধরিয়ে তাদেরও ব্রাশফায়ার করে স্তূপে ফেলা হয়। ’
এরপর রবীন্দ্র মোহনদের পালা। আবার ১৬ জনকে লাইন ধরানো হয়। রবীন্দ্র মোহন ছিলেন গ্রুপে সবার ছোট। লাইন ধরিয়ে নেয়ার সময় এক বয়স্ক আর্মি এসে তাকে বুটের লাথি দিয়ে সরিয়ে দেয়। বাকি ১৫ জনকে দিয়ে আরো বাকি লাশগুলো টানায়। এবার দেখা যায়, দর্শনের শিক্ষক জি সি দেব, মধু চন্দ্র দেবের লাশও।
আর লাশ টানা এই হতভাগ্য ১৫ জনের মধ্যে ছিলেন, শিবপদ কুড়ি, শংকরপদ কুড়ি, বুধিরাম, মুন্নিরাম, চান্দেও, মরভরণ রায়, মিস্ত্রী রায়সহ আরো অনেকে। ব্রাশ ফায়ার করে তাদেরও লাশের স্তুপে ফেলে যায় হানাদারেরা।
কিছুক্ষণ পর মনে হয় হানাদারেরা চলে গিয়েছে। লাশের স্তূপ থেকে একজন গুলিবিদ্ধ হাত বাড়িয়ে ডাকতে থাকেন। রবীন্দ্র মোহন এগিয়ে গেলে পানি খেতে চান। তিনি দৌড়ে পুকুরের কোণে এসে হাত দিয়ে পানি নেন দুই তিনবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পানি থাকে না। এরপর একটা ভাঙা ডিব্বায় করে পানি নেন। অর্ধেক পড়ে যায়। রক্তাক্ত মুখের ঠোঁটে পানি ছুয়েছিল কিনা! সঠিক বলতে পারবেন না তিনি। তবে লোকটি মারা যায়।
রবীন্দ্র মোহন বলেন, ‘মরভরণ এরপরও কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন। তার স্ত্রী ও মা এসে ঘরের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে মারা যান। অনেকে তাদের বলেন, পাঞ্জাবিরা এসে যদি লাশ ঘরে দেখে আবার হামলা করবে। ওরা লাশ রেখে আসে আবার স্তূপে। ’
২৬ তারিখ গোলাগুলি বন্ধ হলে, যে যেভাবে পারে জগন্নাথ হল থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যান। রবীন্দ্র মোহনদের যুদ্ধের বাকি সময় কাটে ঢাকার আশপাশে পালিয়ে বেরিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
এমএন/এমজেএফ