ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

উৎসবের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেছে আইশাদের

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৭
উৎসবের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেছে আইশাদের উৎসবের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেছে আইশাদের/ছবি: বাংলানিউজ

পবার মথুরা (রাজশাহী) থেকে ফিরে: ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১১টা। আগুনমুখো সূর্য যেন কেবলই মাথার উপর উঠছে। চামড়ায় ভাজ পড়া পৌঢ় নারী আইশা বেওয়ার চিফ দিয়ে তখন ফোটা ফোটায় ঘাম গলিয়ে পড়ছে। কিন্তু কিসের রোদ আর কিসের গরম।

দুই হাতে কাঠের নিড়ানি দিয়ে ঠেলে অনবরত ধান নিড়িয়ে চলছেন এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত।  

পাশে তাকাতেই দেখা গেলো তার আরও দুই সাথী ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে চাতালের তপ্ত টিনের ছায়ায় গা এলিয়ে দিয়ে খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছেন।

কাছে গিয়ে বৈশাখী উৎসবের কথা বলতেই তারা যেন ধাঁধায় পড়ে গেলেন। কিছুটা সময় কোনো উত্তর নেই তাদের মুখে। পরে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন- ‘আমাদের আবার কিসের বৈশাখ!   

হ্যাঁ, চাতাল শ্রমিক আইয়াশাদের জন্য বছরের সব দিনই সমান। ঈদ বা বৈশাখ কোনো বিশেষ দিনের আনন্দই আর এখন স্পর্শ করতে পারে না তাদের। দারিদ্রতার কুঠারাঘাতে বর্ণিল উৎসবের দিনগুলো আজ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে তাদের জীবনে। পেটের ক্ষুধার কাছে বড় অসহায় হয়ে পড়েছে বর্ষবরণের আনন্দোৎসব। মাটির পাত্রে পান্তা ভাত অনেকের কাছে আজ অম্লমধুর হয়ে উঠলেও গ্রীষ্মের সকালের রোজকার পান্তা-মরিচের স্বাদ এখন বিষের মত লাগে তাদের।

রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রামের নাম মথুরা। শুক্রবার ওই গ্রামের একটি চাতালে গিয়ে দেখা যায় ধান শুকানো ও নিড়ানো নিয়ে ভীষণ কর্মব্যস্ত রয়েছেন চাতাল শ্রমিক আইশারা। শহর থেকে গ্রাম। সকাল থেকে চারিদিকেই বর্ণাঢ্য আয়োজন চলছে বর্ষবরণের উৎসব। তবে সব কিছুকে পেছনে ফেলে পেটের দায়ে আজকের দিনেও তারা ধানের চাতালে কাজ করছেন। কিন্তু এর জন্য নেই কোনো বাড়তি মজুরি বা বাড়তি কোনো সুবিধা।

উৎসবের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেছে আইশাদের/ছবি: বাংলানিউজচাতাল শ্রমিক আইশা জানালেন, স্বামীর মৃত্যু হয়েছে আরও ১৫ বছর আগে। একমাত্র ছেলে অটোরিকশা চলায়। আর তিনি ধানের চাতালে কাজ করে যা পান তাই দিয়ে চলে অভাবের সংসার। কোনো উপাই নেই। ইউনিয়ন পরিষদের দরজায় বছরের পর বছর ঘুরেও একটি বিধবা কার্ড আদায় করতে পারেননি। তাই নুন আনতেই পান্তা ফুরোই অবস্থা। পহেলা বৈশাখ তো অনেক দূরের কথা বছরের দুই ঈদেও ঘরে ভালো-মন্দ খেতে পারেন না জানান আইশা বেওয়া।  

চাতালে বিশ্রাম নেওয়ার সময় সারেজান বেওয়া নামের অপর নারী শ্রমিক বলেন, সাবেক ইউপি সদস্য আবু তাহেরের এই চাতালে তারা বর্তমানে ছয়জন নারী কাজ করেন। ভোর ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ চলে। দুই বেলায় তিনজন তিনজন করে মোট ছয়জনকে কাজ করতে হয়। পুরুষ শ্রমিকরা কেবল ধান ভাঙ্গে এবং বস্তাজাত করে।  

ধান ভেজানো, সিদ্ধ করা, শুকানো ও নিড়ানোর সব কাজ তাদেরই করতে হয়। তবে এজন্য কোনো নগদ মুজুরি পান না তারা। ১০ বস্তা চাল ভাঙানো হলে জনপ্রতি আড়াইশ’ গ্রাম করে চাল পান তারা। প্রতিদিন ৪০ বস্তা করে করে চাল ভাঙানো হয়। এ জন্য ১৩ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। এতে দুই কেজির একটু বেশি করে চাল পান একেক জন। তবে প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন কাজ হয় চাতালে। অন্য সময় মানুষের বাড়িতে বা জমিতে কাজ করেন তারা।  

শাহানা বেগম নামে আরও এক শ্রমিক বলেন, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য ও অগ্রহায়ণ এটা চাতাল শ্রমিকদের জন্য ভরা মৌসুম। এ সময় কেউ বেকার থাকেন না। সবার হাতেই কাজ থাকায় কিছু হোক আর না হোক অন্তত তিন বেলা পেট পুরে খেতে পারেন। অন্য সময় এক বেলা খেলে অন্য বেলা অভূক্ত থাকতে হয়। এভাবেই দিন যায় বছর কাটে তাদের।   

পহেলা বৈশাখ প্রশ্নে এই নারী শ্রমিকরা বলেন, অন্যের আনন্দের মাঝেই আমরা নিজের সুখ খুঁজে ফিরি।
  
বাংলাদেশ সময়: ২০৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৭
এসএস/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।