জীবন নিয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া মানুষটা তার নিজের কষ্ট বুঝি এভাবেই লুকিয়ে চলেন। স্পিডবোটের গতি একটু কমিয়ে ডুবু ডুবু দ্বীপগ্রাম শিমুলবাগের ওপাশটায় দেখালেন আঙুল তুলে।
ওই যে ওখানে। পানির ওপরে যে হিজল গাছটা দাঁড়িয়ে আছে, ওখানেই ৭০ শতক জমিতে ধান বুনেছিলাম। বিরি-২৮, বিরি-২৯ আর হিরো। সপ্তাহ দুই পর কাটবো বলে লোকজনকে বলে রেখেছিলাম। কিন্তু হুট করে কি হতে কি হয়ে গেলো।
ধরে আসা গলাটা ফের স্বাভাবিক করে ফেললেন সাইফুল। অসমাপ্ত কথার খেই ধরে বললেন, সেদিন বিকেলেও দেখলাম সব ঠিক আছে। কিন্তু সকালেই দেখি থই থই পানি। সারা বছরের খোরাকি খাইলো অকাল ঢলে। মাথাটা তো আউলাইয়া গেছে।
যতোই আউলা বলুক নিজেকে, সাইফুলের দক্ষ হাতে ৫০ কিলোমিটার গতিতে নিরাপদেই ছুটছে সড়ক ও জনপথের স্পিডবোট। সারা বছরের খোরাকি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার গল্পটা নিজে থেকে না বললে বুঝতে পারে কার সাধ্যি।
নিজেরই ৫ ছেলে আর ৩ মেয়ের সংসার তার। বড় দু’ভাই মারা যাওয়ায় তাদের সংসাদের জোয়ালটাও তার কাঁধে। আরো আছে বোন, ভাগ্নে। ছোট ভাইটা তাকে যদিও সাহায্য করতো। কিন্তু অন্তত ৩শ’ মণ ধান তলিয়ে গেছে তারও।
স্পিডবোট চালকের বেতন হিসেবে প্রতি মাসে পাওয়া ১১ হাজার ৭শ’ ৫৩ টাকাই এখন ভরসা তার।
দেখতে দেখতে কাটাখালীর মোহনা ছুঁয়ে যায় স্পিডবোট। পূর্ব দিকে ডুবু ডুবু হাওরের সুন্দরবন। পশ্চিমে যেনো পানির ওপরে ভেসে আছে জিরাতিদের (হাওরের অস্থায়ী অধিবাসী) গ্রাম। কয়েক ডজন গবাদিপশু গা ঘেঁষাঘেঁষি করে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ এক টুকরো দ্বীপের ওপর।
তার পেছনে দিগন্ত বিস্তৃত পানির নিচে যে হাজার হাজার একর ধানক্ষেত তলিয়ে গেছে তার খোঁজ এই ভুক্তভোগী কৃষকরা ছাড়া আর কেইবা রাখে!
কোথাও কোথাও এখনো কোনো মতে পানির ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক একরের খণ্ড খণ্ড ধানের ক্ষেত। মাত্র কয়েক ইঞ্চি করে পানির ওপরে ভেসে থাকা ধানক্ষেতগুলো যেনো সুবিশাল ঘাসের মাঠ। আধা পচা ধান গাছ তুলে নৌকা বোঝাই করছে চাষি। কিছু পাওয়া যাক বা না যাক, শ্রমে-ঘামে নিজেদের নিয়োজিত রেখে সব হারানোর কষ্টটা বুঝি ভুলতে চাইছে তারা।
কিন্তু এসবে খেয়াল নেই বক, বালি হাঁস আর পানকৌড়িদেরল ইচ্ছামতো হাওরে উড়ে খাবার খুঁজছে তারা।
একখানে দেখা গেলো, জনা দশ বারো কৃষক ধানের ডগা কাটছে কোমর পানিতে নেমে। গতি কমিয়ে পাশ কেটে বেরিয়ে যাওয়া স্পিডবোটটাকে কাস্তে ধরা হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালো তারা। এতো কষ্টের ভেতরেও অতিথি অভিবাদনের অমায়িক হাসি সবার মুখে।
পাশেই অকাল বন্যায় নাকাল হওয়া লাউমাচায় শুকিয়ে হলুদ হয়ে আছে সবুজ ডাঁটা। মাঝেমধ্যেই শুকিয়ে যাওয়া হলদেটে ভুট্টা ক্ষেত। এসব ছাড়াও আলু, বাদাম, মূলা আর বেগুন ডুবেছে অসময়ের বন্যায়।
এমনিতেই প্রতিবছর বৈশাখের শেষ থেকে কার্তিক পর্যন্ত পানিতে ডুবেই থাকে হাওরের এসব জমি। সমতলে কার্তিকে যখন নবান্নের উৎসব শুরু হয় তখন সবে চাষের তোড়জোড় শুরু হয় হাওরে। শুকিয়ে যাওয়া হাওরে তাই একবারই ফলস ফলে বছরে। কিন্তু এবার ফসল তোলার আগে আগে সব ভাসিয়ে নিয়েছে বন্যা।
আসছে বছরের খোরাকি নিয়ে তাই অনিশ্চয়তা দানা বেঁধেছে হাওরের কৃষকের মনে। এ অনিশ্চয়তার শেষ কোথায় জানে না ওরা। তারওপর মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে মাথায় ঝুলছে উচ্চ সুদে নেওয়া দাদনের টাকা।
সর্বস্বান্ত কৃষক তায়ের আলীর ভাষায়, হাওরে এবার মরার বছর। খোরাকির অভাবে না খেয়ে মরা ছাড়া উপায় কি আর! ঢলের সঙ্গে জানটাও গেলে তো আর এতো কিছু ভাবতে হতো না!!
আরও পড়ুন
** মাছ নাই রে ভাই
** ধুঁকতে থাকা স্বপ্নও শেষ বৃষ্টিতে
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৭
জেডএম/