কিশোরগঞ্জ ও তার হাওর জনপদের সেতুবন্ধন এই চামড়া বন্দর। বিস্তৃত হাওরাঞ্চলের সঙ্গে জেলা সদরের যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গেটওয়ে।
জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের চামড়া বন্দরে যাওয়ার সড়ক চলে গেছে করিমগঞ্জ উপজেলার ভেতর দিয়ে।
সুন্দর মসৃণ পিচঢালা পথ। দু’ধারে চিরায়ত বাংলার প্রতিচ্ছবি। ফসলের ক্ষেত, ব্যস্ত কিষাণ কিষাণি। মাঠ থেকে ধান কেটে এনে রাখা হয়েছে সড়কের ধারে। ধানের গোছায় ভারী শীষ দেখেই বোঝা গেল ফলন বাম্পার। রাস্তার ধারের এসব ফসলের ক্ষেতগুলোতে বন্যা কিংবা ঢলের কোনো চিহ্ন দেখা গেল না।
বিষয়টি জিজ্ঞাসা করতেই সিএনজি অটোরিকশা চালক জানালেন, এই এলাকাটা উঁচু। এ কারণেই ঢলের পানি এ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তাই এখানে ধানের কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি যা হয়েছে তা নামা অঞ্চলে। নামা অঞ্চল শুরু হয়েছে চামড়া বন্দর ঘাটের মুখ থেকে। এখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ধনু নদী। আর ধনু নদী থেকেই মূলত শুরু হাওরের বিস্তৃতি। যা চলে গেছে বহুদূরের সুনামগঞ্জের ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা পর্যন্ত।
ঘাটে পৌঁছাতেই পুরোপুরি বোঝা গেল বিষয়টি। ঘাটের সামনে প্রায় দিগন্ত বিস্তৃত পানি। মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে ছোট ছোট সবুজ ভূ-খণ্ড। ওগুলোই হাওরাঞ্চলের এক একটা গ্রাম।
এই ঘাঁট থেকে মোটামুটি কিশোরগঞ্জের হাওরের সব জায়গাতেই যাওয়া যায়।
এই জেলার হাওরাঞ্চলের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন উপজেলা ইটনা। বর্ষাকাল এমনকি বর্ষাকাল ছাড়াও
কিশোরগঞ্জ সদর থেকে ইটনা উপজেলায় যাওয়ার একমাত্র এবং সবচেয়ে সহজ হলো নৌপথ। এবারের ঢলে কিশোরগঞ্জের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাও ইটনা।
ইটনার নৌকা ছাড়তে বাকি আছে প্রায় ঘণ্টাখানেক। তাই জিরিয়ে নিতে বসলাম ঘাটের ঠিক মুখেই জামিলের চায়ের দোকানে।
দোকানটিতে মানুষজনের বেশ জটলা। অনেকেই অপেক্ষা করছেন নিজ নিজ গন্তব্যের নৌকার জন্য।
সেখানে চা খাচ্ছিলেন হাওরের বাসিন্দা মিনু মিয়া। বাড়ি মিঠামইনের ঘাগড়া ইউনিয়নে। তার কাছ থেকেই জানা গেলো, চামড়া ঘাঁটের সামনে থেকেই যে পানির বিস্তার সেখানে ছিলো মূলত ধানের ক্ষেত।
কয়েকদিন আগেও হাওরে পানি ছিলো মূলত ধনু নদীতে। আর হাওরের বাকি মাইলের পর মাইল এলাকা শুধুই ধানের ক্ষেত। কিন্তু চৈত্র মাসের অকাল ঢলে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই পানিতে তলিয়ে যায় পুরো এলাকা। এখন হাওরের ধানের ক্ষেত আর ধনু নদী একাকার হয়ে গেছে ঢলের জলে।
হাওরে মিনু মিয়ার নিজেরও প্রায় ২০ কানি ক্ষেত ছিলো। সবটুকুই ডুবে গেছে ঢলে। কোনো ধান রক্ষা করতে পারেননি তিনি। এখন চিন্তায় আছেন সারা বছরের খোরাকি নিয়ে। পরবর্তী ধান উঠতে আরও এক বছর। এই এক বছর কি খাবেন তাই নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তিনি।
গোয়ালের গরুগুলোকে নিয়েও দুশ্চিন্তা কম নয়। বেশ কয়েকটি গরু আছে তার। নিজের ক্ষেত থেকেই গরুগুলোর পর্যাপ্ত খড়ের যোগান হয়ে যেত। কিন্তু এবার এক মুঠ খড়ও পাননি। নিজে খাবেন কি, আর গরুকে খাওয়াবেন কি। তাই ভেবে অস্থির হাওরের এই গৃহস্থ।
একই কথা বললেন, মিঠামইনের কলাপাড়ার ওয়াহাব মিয়াও। কিশোরগঞ্জ থেকে আসছেন তিনি।
কিশোরগঞ্জ থেকে চামড়া বন্দর পর্যন্ত পথের দুই পাশে ধানের সমাহার তাদের দুঃখ যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখানে এখন মহাসুখে ধান মারাই কাটাই করছেন কৃষকরা। এখন তারাও ব্যস্ত থাকতেন একই কাজে।
আসলে মারাই কাটাইয়ের সময়ে দম ফেলার ফুরসতটুকুও থাকে না হাওরের কৃষকদের। অথচ সেখানে এখন তাদের কোনো কাজই নেই। চুপচাপ বসে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া যেন আর কোনো গত্যন্তর নেই তাদের।
ওয়াহাব মিয়া জানালেন, কিশোরগঞ্জ থেকে চামড়া বন্দর আসার পথে হাওরের অনেক কৃষকই নাকি ক্ষণিকের তরে থমকে দাঁড়িয়েছেন রাস্তার দুধারের ধানের ক্ষেতগুলোতে। ধানের ক্ষেতের শীষ হাতে নিয়ে অনেকে ভেঙে পড়েছেন কান্নায়।
আসলে ধান হাওরের মানুষের সন্তানের মতন। এই ধানই তাদের সারা বছরের বেঁচে থাকার সব চাহিদা মেটায়। দেশের অন্যান্য এলাকায় ফসলের যে বৈচিত্র্য, তা হাওরে অনুপস্থিত। এখানে ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল হয় না। বিকল্প জীবিকারও ব্যবস্থা না থাকায় এখানকার মানুষের বিয়ে শাদি লেখাপড়া অন্যান্য সব প্রয়োজনই মেটে ধান বিক্রির টাকা থেকে। সেই ধানই যদি না থাকে তবে হাওরবাসীর জন্য জীবন হয়ে দাঁড়ায় বর্ণবিহীন।
দেশের অনেক জায়গাতেই যাওয়া হয়েছে। পরিচয় রয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গেও। কিন্তু ধানের সঙ্গে কৃষকের এমন অবিচ্ছেদ্য সংযোগ আর কোথাও চোখে পড়েনি।
ধানের সঙ্গে হাওরের কৃষকের যেন নাড়ির টান। এই নাড়ির টানই যেন তাদের পোড়াচ্ছে আরও বেশি করে।
**হাওর ডোবার দায় নিলেন না কিশোরগঞ্জের পাউবো কর্তারা
**সরকার হাওরবাসীকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবে
**হাওরের বুকে ‘কালবৈশাখী’ দর্শন
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৮ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৭