ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৭ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

খোঁজ নেই ‘হাওর পঞ্জিকা’র!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০২ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৭
খোঁজ নেই ‘হাওর পঞ্জিকা’র! বন্যা কবলিত হাওরের গ্রাম। ছবি: মুনতাসীর ফারুক জাফরি

চামড়াঘাট, করিমগঞ্জ (কিশোরগঞ্জ) ঘুরে: পুবের সূর্যের রঙ তখনো কাঁচা হলুদের মতো টলটল করছে। শহরের একরামপুর পয়েন্ট ভালো ভাবে জাগেনি এখনো। ‘হাওরের বন্যার লাইগ্যা সব ঠাণ্ডা।

আগে ফজরের সময়ই বাস, টেম্পু চলা শুরু অইতো। অহন ঝিমাইন্যা ভাব।

জোয়ান রিকশাচালক জাহাঙ্গীরের কথার সত্যতা মেলে চারদিকে তাকিয়ে। রাস্তার পাশে বাঁশের বেড়ার একটি অস্থায়ী চা-স্টলে চুলার আগুন সবে মাত্র কুণ্ডলী পাকিয়েছে। ‘বইন, চা খাইতে খাইতে গাড়ি পাইবাইন। ’ আশপাশে কোনো যানবাহন নেই। সদাশয় দোকানির আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে উপায় কি?

একরামপুর থেকে পূর্বমুখী রাস্তা চলে গেছে করিমগঞ্জ উপজেলা সদর হয়ে আরো পূর্ব দিকের চামড়াঘাটে। বন্দর নামে উন্নীত হলেও সাধারণ মানুষ চামড়াঘাট হিসাবেই জানে। জেলার পূর্বাঞ্চলীয় হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিটামইন, অষ্টগ্রামের প্রবেশ দ্বার চামড়াঘাট যেতে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি অপেক্ষা করতে হলো।

হাওরের বন্যায় মানুষ ও মাল চলাচলে স্থবিরতা নেমেছে। ধান-চাল আসছে না। কৃষি শ্রমিক, দাদনদার, গৃহস্থের আসা-যাওয়াও কম। জলমগ্ন হাওরে এখন কাজ নেই। ভিন জেলার শ্রমিকরাও সে খবর জেনে গেছে। কাজের সন্ধানে তারা এবার পাড়ি দিয়েছে অন্যত্র, বিশেষত বৃহত্তর চট্টগ্রামের দিকে। হাওরের গৃহস্থরা ঘর-বাড়ি বাঁচাতে ব্যস্ত। শহরে আসার কোনো প্রয়োজনীয় কারণ এবং আর্থিক সঙ্গতি নেই তাদের। স্বাভাবিক সময় হলে ধান বিক্রি করতে বা অন্য কারণে তারা আসেন। এই দুর্যোগে কে আসবে?

যানবাহনের চালকরাও যাত্রীর চাপে নেই। সকাল সাতটা নাগাদ একটি সিএনজি পেয়ে তাতেই চেপে বসা গেল। যাত্রী পেলে লাইনের টেম্পু বা বাস ছাড়বে আরো পরে। ‘আগে হইলে অতক্ষণে দুই ট্রিপ দিলাম। ’ সিএনজির গতি বাড়াতে বাড়াতে বলেন চালক ইব্রাহিম। পাশের তারাপাশা গ্রামেই তার বাড়ি। হাওরের বন্যার কারণে তারও মন খারাপ। আয়-রোজগার অনেক কমে গেছে।

আধা ঘণ্টারও কম সময়ে চামড়াঘাটে সিএনজি এসে থামে। রাস্তা-ঘাট ভিড়হীন। যানবাহনের চাপ নেই। আসতে তাই কম সময়ই লেগেছে। চামড়াঘাটও চাঞ্চল্যহীন। অন্য সময় স্থানীয় ধরনের গয়না নৌকা আর ট্রলার বোঝাই মালপত্র ও মানুষ পাড়ি দিত ইটনা হয়ে সুনামগঞ্জের পথে; কিংবা মিটামইন হয়ে হবিগঞ্জ বা অষ্টগ্রাম হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে। হাওর-বাওর-নদীর তাজা মাছের এক বিরাট আড়ৎ জমে উঠত এখানে। পাইকার ও কিশোরগঞ্জ শহরের ভোজনপ্রিয় মানুষজন জ্যান্ত মাছ কিনতে এখানে চলে আসতেন। হাওরের পথে নৌকায়বন্যার কারণে আগের রমরমা আর নেই। সবার মুখেই আশঙ্কার কালো মেঘ। সঙ্গে দূরের বন্যা কবলিত হাওরাঞ্চলের আকাশে হঠাৎ হঠাৎ পুঞ্জিভূত কালবৈশাখী ঝড়ের কালচে ভাসমান মেঘের প্রলম্বিত ছায়া। ‘বন্যার পরে অবস্থা কোন দিকে যায়, বলা মুস্কিল। ’ চামড়াঘাটের সম্পন্ন ব্যবসায়ী আলহাজ চাঁন মিয়ার কণ্ঠে হতাশার সুর।

চামড়াঘাট ভাটি আর উজানের সঙ্গমস্থল। হাওরকে সাধারণ ভাষায় বলা হয় ভাটি এলাকা। হুমায়ূন আহমেদের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ’ গানটির কথা এই দুর্যোগে অপ্রাসঙ্গিক হলেও মনে পড়ল। কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জলমগ্ন এলাকাগুলো নিয়ে আলাদা ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের নান্দনিক দিক নয়, চলমান সঙ্কটই এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়।

চামড়াঘাট করিমগঞ্জ উপজেলাধীন। পাশেই নেয়ামতপুর ইউনিয়ন। হাওরের বন্যার ধাক্কা এসে স্থানীয় নদী-খালগুলোতেও আছড়ে পড়ছে। এখানকার সাবেক জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান প্রয়াত মোস্তফা ফারুক নাদিমের স্ত্রী শায়লা পারভীন সাথী এখন জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য। তিনি কয়েকজন সহকর্মীসহ আশেপাশের এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন।

নদীটির ওপাশেই ইটনা উপজেলার শুরু। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ দেখতে আশপাশের গ্রামগুলোতে যাচ্ছেন তিনি। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তাঁর সহযাত্রীদের সঙ্গে আমরাও রওয়ানা দিলাম। চারিদিকে থৈ থৈ পানি। দূরে আবছা কুয়াশার মধ্যে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো গ্রামের রহস্যময় অবয়ব। আকাশে আজও রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি। সকালে থেমে থেমে বৃষ্টির ঝাপটা।

নৌকায় যেতে যেতে পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির ঐতিহ্যসম্পন্ন পরিবারের সদস্য শায়লা পারভীন সাথী বললেন, ‘আমাদের প্রধান কাজ হলো সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ ও পুনর্বাসন তদারকি করা। কোথাও কোথাও রিলিফের চাল চুরির খবর পাওয়া যাচ্ছে। সরকার এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে কঠোর। আমরাও মাঠে আছি। ’

তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম হাওরের বন্যা ও দুর্যোগের স্থায়ী সমাধান সম্পর্কে? বললেন, ‘হাওর একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এলাকা। এখানকার জন্য আলাদাভাবেই নীতি, পরিকল্পনা ও প্রকল্প নেওয়া দরকার। ’

তিনি বলেন, ‘হাওর পঞ্জিকা’ নামে ক্যালেন্ডারের মতো একটি কৃষি-দিনপঞ্জীর কথা আজকাল কেউ কি জানেন? কোন মাসে হাওরে কোন জাতের ধান রোপণ করতে হবে, কোন মাসে কোন মাছ ডিম দেবে, কোন মাসে কৃষকদের করণীয় কি, তা সে পঞ্জিকায় বিস্তারিত থাকার কথা। আমরা অতীতে এমন পঞ্জিকার ব্যাপক প্রচলন দেখেছি। এখন সেটা আদৌ আছে কি না জানি না। ’ নৌকার এক যাত্রী চট করে বলে ওঠলেন, ‘কৃষক তো দূরের কথা, কৃষি ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা সে খবর রাখেন কি না সন্দেহ!’

বক্তার কথায় সবাই সায় দিলেন। জেলা পরিষদ সদস্য শায়লা পারভীন সাথী বললেন, ‘হাওরের সমস্যা নিয়ে গভীরে ভাবা হচ্ছে না। সবাই উপর থেকে দেখছেন, সমস্যার মূলে যাচ্ছেন না। ’ তাঁর বক্তব্যকে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করতে বলায় তিনি বলেন, ‘সবাই কি এ কথাটা জানে যে, অসময়ের পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় পাকা ধান তলায় নি, ডুবেছে কাঁচা ধান? কেউই বিআর-২৯ জাতের ধানের চারা রোপণে কৃষকদের সুপরামর্শ দেয় নি বা বারণ করে নি। এই ধান পাকতে ১৬০-৭০ দিন লাগে। এই ধান লাগানোর উপযুক্ত সময় হতো কার্তিক মাস। এসব তথ্য কৃষকদের জানানো হয় না। হাওরে বিভিন্ন প্রকল্প ও অবকাঠামোগত প্রস্তুতির পাশাপাশি আমরা হাওর পঞ্জিকা প্রণয়নসহ কৃষক, মৎস্যজীবীকে দুর্যোগ মোকাবেলার প্রশিক্ষণ ও অন্যবিধ দক্ষতা উন্নয়নমূলক কর্মসূচির কথা ভাবছি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন আমাদের লক্ষ্য। তাছাড়া মহামান্য রাষ্ট্রপতির এলাকা হওয়ায় এখানকার মানুষের প্রয়োজনে আমরা সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ’

হাত্রাপাড়া গ্রামে নৌকা এসে থেমেছে। লোকজন ভিড় করলেন প্রধানত নেতা-নেত্রীদের ঘিরে। একপাশে দাঁড়িয়ে প্রায়-নিথর গ্রামের চারপাশ দেখছি। শায়লা পারভীন সাথী দলবলসহ লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গ্রামের ভেতরে চলে গেলেন। ঘাটে কয়েকজনকে পেয়ে আমি ‘হাওর পঞ্জিকা’ ও কৃষি বিভাগের কার্যক্রম বা পরামর্শ সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি। এক পাশে বসে ছিলেন অবসরপাপ্ত শিক্ষক আবদুল লতিফ মাস্টার।

আমার কথা শুনে বললেন, ‘কৃষি বিভাগের তরফে বিস্তৃর্ণ হাওরের চাষাবাদের ব্যাপারে যথাসময়ে সঠিক পরামর্শ দেওয়া হয় না। বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে এবং কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ে কৃষকরা যে বীজ, সার বা কীটনাশক ব্যবহার করেন, সেগুলোর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তারা মোটেই অবহিত নন। কৃষি বিভাগের পক্ষেও সতর্কতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। চলছে ফ্রি-স্টাইল অবস্থা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত কৃষকদের আগেভাগে সতর্ক করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। ’ জানতে চাইলাম ‘হাওর পঞ্জিকা’ সম্পর্কে। ‘আগে দেখেছি। এখন তো দেখি না। ’ বললেন কেউ কেউ। ‘আবার এসব তথ্যমূলক বইপত্র প্রচার-প্রকাশ করা দরকার বলে মত দিলেন লোকজন।  

দুপুরের দিকে কিশোরগঞ্জ শহরের ফিরতি পথ ধরি। আবার নৌ-যাত্রা। আবহাওয়া ভালো থাকায় সহজেই পৌঁছা গেল চামড়াঘাটে। সেখান থেকে শহরের একরামপুর বাসস্ট্যান্ডে নামতেই বিকেলের শুরু হয়ে গেছে। নেমেই তীক্ষ্ণ চোখে চারপাশে তাকাই। জেলার কৃষি সামগ্রীর বড় মার্কেটটি এখানেই অবস্থিত। কৃষিভিত্তিক হাওরের যোগাযোগ পয়েন্ট হওয়ায় এখানেই গড়ে উঠেছে কৃষি সমাগ্রীর বড় বাজার। কৃষি মার্কেটের ৩০/৪০টি দোকানে দেদারে বিক্রি হয় নানা জাতের বীজ, কীটনাশক, রাসায়নিক দ্রব্য। বাংলাদেশের ফার্মেসিগুলোতে যেমন কেমিস্ট বা ড্রাগিস্ট পদাধিকারি কেউ থাকে না, কৃষিভিত্তিক রাসায়নিক দ্রব্যের বিক্রেতাদের হাল আরো খারাপ। বাংলা-ইংরেজি পড়তে পারে না এমন কর্মচারী দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির প্রতিনিধিরা যে ব্রিফ দেন, সেটার ওপর ভিত্তি করেই বিপদজ্জনক দ্রব্য-সামগ্রী কেনা-বেচা হচ্ছে।

একটি দোকানে বসে মালিকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস আর তার বালক-কর্মচারী নাম দস্তখত করতে পারেন। এই ব্যবসায় নিজেকে বেশ অভিজ্ঞ দাবি করলেন তিনি। ব্যবসার সব আটঘাট জানেন। লাভের হিসাব ভালো বুঝলেও রাসায়নিক বা পরিবেশগত দুষণ সম্পর্কে যে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, সেটা বেশ বোঝা গেল।

শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগই নয়, পরিবেশগত ও রাসায়নিক দিক থেকে ধেয়ে আসা নানাবিধ দুর্যোগ এবং বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা হাওরের সমস্যাগুলোকে আরো প্রকটিত করছে। কৃষি ও মৎস্য খাতের জন্য পারস্পরিক সমঝোতা এক্ষেত্রে অপরিহার্য। মাছের জন্য যখন পানির দরকার হবে, ধানের জন্য প্রয়োজন হবে পানি সরে যাওয়ার। কৃষক বা মৎস্যজীবীরা নিজ নিজ উদ্যোগে কাজটি করতে পারবেন না। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ লক্ষ্যে সমন্বয় সাধন করে দিতে হবে।

শুধু এই অকাল বর্ষণ আর বন্যার সময়েই নয়, হাওরের জন্য দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তাই বার বার সামনে চলে আসছে। সংশ্লিষ্টদের আজকের সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করার জন্যও প্রস্তুত হতে হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, অতিথি লেখক
ড. মাহফুজ পারভেজ, অতিথি লেখক

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।