ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৭ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

‘দেহি যদি কিছু মেলে’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৭ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৭
‘দেহি যদি কিছু মেলে’ ধান পাবেন, এ আশায় নিবিষ্ট মনে ‘ছাবনি’ রোদে শুকানোর কাজ করছেন জরিনা। ছবি: বাংলানিউজ

নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল থেকে: নিবিষ্টমনে পচে প্রায় কালো হয়ে যাওয়া ধান শুকোনোর জন্য পথের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন জরিনা খাতুন। এগুলোকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ছাবনি ধান। পানির নিচ থেকে বিশেষ ধরনের আঙটার সাহায্যে প্রায় পচে যাওয়া ধানকে স্থানীয় ভাষায় ‘ছাবন’ বা ছেকে তুলে আনা হয় বলে এই ধানের নাম ছাবনি।

কালো ময়লা-আবজর্নাযুক্ত ওই ছাবনি ধানের মধ্যে আসল ধান কতটুকু আছে তা অবশ্য বোঝা মুশকিল। তবে জরিনা খাতুনকে দেখা গেল, খুব নিবিষ্ট মনেই ওই ধানের পরিচর্যা করতে।

পাশেই একই পরিবারের লালফর মিয়া। মূলত লালফর মিয়াই নৌকা নিয়ে হাওরে গিয়ে ডুবে যাওয়া পাকা ধানের ক্ষেত থেকে এই ছাবনি ধান তুলে এনেছেন। এখন শুকানোর কাজ করছেন তার মেয়ে জরিনা খাতুন।

চোখে দেখেই বোঝা যায়, এই ধানের থেকে আসল ধান বের করা বেশ মুশকিলই হবে। কারণ বেশিরভাগটাই পচে কালো হয়ে গেছে। ধানের থেকে চিটা ও ময়লা আবজর্নাই বেশি। তবু বেশ যত্ন নিয়ে নিবিষ্ট মনে ‘ছাবনি’ রোদে শুকানোর কাজ করছেন জরিনা।  

জরিনা জানালেন, এই ধান থেকে দানাদার ধান ছেকে বের করা খুবই শ্রমসাধ্য কাজ। দফায় দফায় এই ধান শুকানোর পর ঝাড়তে হবে। বেশ কয়েক দফা এভাবে ঝাড়া ও বাছাইয়ের পরই মিলতে পারে সামান্য কিছু ধান।  

জিজ্ঞাসা করা হলো, সামান্য কিছু ধানের জন্য এতো কষ্ট কেন করছেন?
‘দেহি যদি কিছু মেলে?’ একযোগে উত্তর দিলেন লালফর মিয়া এবং জরিনা।  
ধান পাবেন, এ আশায় নিবিষ্ট মনে ‘ছাবনি’ রোদে শুকানোর কাজ করছেন লালফর ও জরিনা।  ছবি: বাংলানিউজএই উত্তরের মধ্যেই নিহিত যেন অনেক অনুচ্চারিত বাস্তবতা। এই ‍উত্তরের মধ্যে দিয়ে হাওরের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়।  

খালিয়াজুড়ির লছিবাই গ্রামের বাসিন্দা লালফর মিয়ার হাওরে এবার ধান ছিলো ১৬ কানি জমিতে। পুরোটাই তলিয়ে গেছে ঢলে। উপায়ন্তর না পেয়ে আরও অনেকের মতই নৌকা নিয়ে বের হয়েছিলেন হাওরে। বিশেষ ধরনের এক আঙটার সাহায্যে পানির নিচে থেকে পচে যাওয়া ধানের শীষ তুলে আনার চেষ্টা করেন তারা।

এভাবে পচা ধানের শীষ ঝেড়েই বের হয় ওই কালো রংয়ের প্রায় পচে যাওয়া ছাবনি ধান। এই ছাবনি ধান রোদে শুকিয়ে যদি কিছু পাওয়া যায় সেই আশাতেই যত পরিশ্রম।

এতো সামান্য ধানের জন্য এতো পরিশ্রম করছেন— কেন জিজ্ঞেস করতেই লালফর জানালেন, ‘কী আর করমু, আমাগো তো আর কোনো কাম নাই। বইসা থাকার বদলে যদি কিছু ধান পাওয়া যায়। ’

মূলত লালফর মিয়ার মত অবস্থা হাওরের প্রায় সকলের। গোলায় ধান নেই, হাওরে মাছ নেই। সরকারি রিলিফ আছে, তাও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ওএমএস এর চাল আছে। কিন্তু ১৫ টাকা কেজি দরে সেই চাল কিনে খাওয়ারও যেন শক্তি নেই হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর। এজন্য এই মুহূর্তে এক মুঠ ধানই সোনার মত মূল্যবান তাদের জন্য।  

লালফর জানালেন, যদি তারা জানতেন হাওরের কোনো জায়গায় ডুব দিয়ে এক মুঠ ধান পাওয়া যাবে। তাহলে প্রয়োজনে ডুব দিয়েই ধান সংগ্রহ করতেন তারা। কিন্তু সেই উপায়ও যেন নেই। পানি পানিতে হাওর এখন সমুদ্রসম। বেশির ভাগ স্থানেই পানির গভীরতা গড়ে ছয় ফুটের বেশি।

সব মিলিয়ে হাওরে হাজারো লালফর মিয়া আর জরিনাদের অবস্থা এখন প্রায় একই। একমাত্র সরকারের ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রমই সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে পারে তাদের।

** প্রতি ওয়ার্ড-পরিবারে ওএমএস-ভিজিএফ চান চেয়ারম্যান সোহাগ
** হাওরের জলে অপরূপ সূর্যাস্ত
** নাড়ি ছেঁড়া ধনে টান কৃষকের
** হাওর ডোবার দায় নিলেন না কিশোরগঞ্জের পাউবো কর্তারা
** সরকার হাওরবাসীকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবে
** অকাল ঢলে ভাটির দেশে ‘অশনি সঙ্কেত’ এর পদধ্বনি

** হাওরের বুকে ‘কালবৈশাখী’ দর্শন

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৭
আরআই/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।