ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৭ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

‘ছাবনি’ ধানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম রাজিয়া-নজরুলদের

রাইসুল ইসলাম, এডিশনাল আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৮ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৭
‘ছাবনি’ ধানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম রাজিয়া-নজরুলদের ‘ছাবনি’ ধানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম রাজিয়া-নজরুলদের। ছবি: বাংলানিউজ

খালিয়াজুড়ি (নেত্রকোনার হাওর অঞ্চল) থেকে: দুর্গম হাওরাঞ্চলের প্রত্যন্ততম ইউনিয়নের একটি নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর।

নেত্রকোনা জেলা সদর থেকে সেখানে যেতে সময় লাগে পাক্কা ৫ ঘণ্টা। যার সাড়ে তিন ঘণ্টাই কাটবে নৌকায়।

মাঝে পাড়ি দিতে হবে আজদাহার মতো বিশাল বিশাল এক একটি হাওর।

কৃষ্ণপুর হাওরাঞ্চলে নেত্রকোনা জেলার সীমান্ত। এরপর থেকেই শুরু সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল। এখান থেকে বেশি দূরে নয় সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা।

ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গ্রাম কৃষ্ণপুরকে ঘিরে রেখেছে বিশাল এক হাওর, যার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঠাওর করা মুশকিল। ‘ছাবনি’ ধানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম রাজিয়া-নজরুলদের।  ছবি: বাংলানিউজস্থানীয়দের কাছে এ হাওর ‘ছায়ার হাওর’ নামে পরিচিত।

এই ছায়ার হাওরের তীর ঘেঁষে প্রায় সম্পূর্ণ পচে কালো হয়ে যাওয়া ধানের শীষ শুকোনো-নাড়ানোর কাজ করছিলেন এক প্রৌঢ় নারী। তাকে সাহায্য করছিলেন অন্য এক নারী। পরনের শাড়ি ও চেহারায়ই বোঝা যায়,  ওই প্রৌঢ় নারী বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের।

‘কি করছেন? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন ‘ছাবনি ধান ঝাড়তাছি’।
‘ছাবনি’ ধানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম রাজিয়া-নজরুলদের।  ছবি: বাংলানিউজ
তার নাম রাজিয়া খাতুন, কৃষ্ণপুর গ্রামের বেশ অবস্থাপন্ন কৃষক পরিবারের গৃহিণী। এবারের ঢলে অন্য হাওরের পাশাপাশি শুধু ছায়ার হাওরেই তলিয়ে গেছে তার ২০ কানি (৪০ শতকে এক কানি) জমির ধান। এ ধানই  তাদের পরিবারের মূল আয়ের উৎস। রাজিয়া খাতুনের চার সন্তানের সবাই লেখাপড়া করেন। তাদের মধ্যে এক মেয়ে ঢাকায় পড়াশোনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পড়াশোনার খরচও যোগানো হয় এই ধান বিক্রির টাকা থেকে।

ভারত থেকে নেমে আসা অকাল ঢলে কৃষকের চোখের সামনেই তলিয়ে গেছে কর্তনযোগ্য সোনালি ধান। অকাল ঢলে হাওরের চারদিক এখন পানিতে থই থই। চৈত্র মাস থেকেই হাওরাঞ্চল যেখানে সোনালি রং ধারণ করে, সেটি এখন রুপ নিয়েছে পানির রঙে।
 
হাওরের পানিতে ডুবে থাকা ধান কেটে ঘরে তোলার উপায় না থাকলেও আশা ছাড়েননি অনেকেই। তিন ফলা একটি বিশেষ ধরনের লোহার আঙটার মাথায় দড়ি লাগিয়ে, পানিতে নামিয়ে মাছ ধরার জাল টানার মতো দড়ি ধরে টান দিলে আঙটায় উঠে আসে প্রায় পচে যাওয়া ধানের শীষ। ‘ছাবনি’ ধানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম রাজিয়া-নজরুলদের।  ছবি: বাংলানিউজহাওরাঞ্চলে এখন বেশ চাহিদা এই আঙটার। অনেকেই নৌকায় করে আঙটা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছেন হাওরের বুকে। তারপর মাছ ধরার মতো আঙটা ব্যবহার করে স্থানীয় ভাষায় ‘ছাবনি’ দিয়ে তুলে আনছেন পচা ধানের শীষ। প্রমিত বাংলায় কোনো কিছু ‘ছেচে’ আনাকে স্থানীয় উচ্চারণে হাওরাঞ্চল খালিয়াজুড়ির মানুষ বলেন ‘ছাবন’। আর হাওর থেকে ছেচে আনা ধানকে স্থানীয় উচ্চারণে ‘ছাবনি ধান’ বলা হয়।

দীর্ঘদিন পানিতে থাকায় ধানের গাছ পচে গেলেও পাকা ধান নাকি সহজে পচে না। তাই শেষ ভরসা হিসেবে অনেক কৃষকই রশি বাঁধা আঙটা দিয়ে হাওরের বুক ছেচে বা ‘ছাবনি’ দিয়ে তুলে আনছেন পচা ধানের শীষ।

এখন ছাবনি ধানই হাওরের মানুষের শেষ ভরসা। নৌকা নিয়ে হাওরে দিনভর ঘুরে ঘুরে ছাবনি ধান তুলেছেন নজরুল। তিনি জানালেন, দিনভর দু’জন মানুষ মিলে পরিশ্রম করলে প্রায় তিন মণ পর্যন্ত খড়কুটো ও আবর্জনাযুক্ত ছাবনি ধান ডাঙ্গায় তুলতে পারেন তারা। শুকোনোর পর এখান থেকে হয়তো সর্বোচ্চ এক মণ ধান পাওয়া যেতে পারে।

ছাবনি ধান শুকোনোর প্রক্রিয়াও বেশ জটিল। প্রথমে বেশ কয়েক দফা রোদে দিয়ে ধান থেকে সরানো হয় খড়কুটো ও আবর্জনা। এরপর বের হয় কালো রংয়ের দুর্গন্ধযুক্ত ধান, যার মধ্যে অধিকাংশই চিটা ও পচা। বেশ কয়েক দফা রোদে শুকিয়ে ঝাড়ার পর বের হয় খাওয়ার উপযোগী ধান। ‘ছাবনি’ ধানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম রাজিয়া-নজরুলদের।  ছবি: বাংলানিউজ

সব মিলিয়ে বেশ কষ্টকর এ প্রক্রিয়া। কিন্তু শেষ সম্বলের কিছুটা হলেও ফিরে পেতে গ্রামের অনেক কৃষক ও তাদের বৌঝিরা বাধ্য হয়েই কঠিন এ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

খালিয়াজুড়ির কৃষ্ণপুরের রাজিয়া খাতুন ও নজরুল মাঝি এবং গছিবাই গ্রামের লালফর মিয়া ও রহিমা বেগমসহ হাজারো গৃহস্থ পরিবারের কৃষাণ-কৃষাণিরাও ছাবনি ধান ছেকে তোলার কাজে ব্যস্ত।

কাজ না বলে যাকে সংগ্রাম বলাই শ্রেয়।

** ‘দেহি যদি কিছু মেলে’
** প্রতি ওয়ার্ড-পরিবারে ওএমএস-ভিজিএফ চান চেয়ারম্যান সোহাগ
** হাওরের জলে অপরূপ সূর্যাস্ত
** নাড়ি ছেঁড়া ধনে টান কৃষকের
** হাওর ডোবার দায় নিলেন না কিশোরগঞ্জের পাউবো কর্তারা
** সরকার হাওরবাসীকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবে
** অকাল ঢলে ভাটির দেশে ‘অশনি সঙ্কেত’ এর পদধ্বনি

** হাওরের বুকে ‘কালবৈশাখী’ দর্শন

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৭
আরআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।