ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৭ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

কোমর ভাঙলো হাওরের ‘বড় গেরস্থদের’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩০ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৭
কোমর ভাঙলো হাওরের ‘বড় গেরস্থদের’ ছায়া হাওরের কৃষক-সানোয়ার, ফারুক ও দুলাল- ছবি: বাংলানিউজ

খালিয়াজুড়ি (নেত্রকোনার হাওর অঞ্চল) থেকে:  ছায়ার হাওর। হাওরাঞ্চলের অন্যতম বিশাল হাওর। একই সঙ্গে শস্য ভান্ডার হিসেবেও পরিচিত এই হাওর। হাওরাঞ্চলের ঠিক হৃদয় হিসেবে অভিহিত করা যায় ছায়ার হাওরকে।

হাওরের উত্তর ও পশ্চিম দিকের অংশ পড়েছে নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি ‍উপজেলায়। পূর্বাংশে সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা।

দক্ষিণে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ। এছাড়াও কিছু অংশ পড়েছে কিশোরগঞ্জের ইটনার ভেতর।
কৃষক দুলাল মিয়া
হাওরের মাঝ বরাবর বয়ে গেছে সুরমা নদীর একটি শাখা। অবশ্য হাওরের পানিতে একাকার নদীকে এখন আর আলাদা করে বোঝার কোনো উপায় নেই।

ছায়ার হাওরের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়। এই হাওরের উপর নির্ভরশীল ৪ থেকে ৫টি উপজেলার লাখ লাখ মানুষ।

হাওরাঞ্চলের মানুষের দুঃখ দুর্দশার চিত্র তুলে আনতে রওনা হয়েছিলাম কিশোরগঞ্জের চামটা বন্দর থেকে (স্থানীয়রা ডাকে চামড়াঘাট)। কিশোরগঞ্জের হাওর বিধৌত উপজেলা ইটনা। ইটনা থেকে হাওর পাড়ি দিয়ে নেত্রকোনার খালিয়াজুড়িতে আসার পর খবর পাওয়া গেল এই ছায়ার হাওরের। সেখানে পৌঁছাতে যেতে হবে উপজেলার সব চেয়ে পূর্ব প্রান্তের ইউনিয়ন কৃষ্ণপুরে।

কৃষ্ণপুরের অবস্থান ছায়ার হাওরের মাঝখানে। এখান থেকে নৌকায় ছায়ার হাওরের প্রায় সবখানে যাওয়াটা সহজ।

কৃষ্ণপুরে কথা হলো গ্রামের বড় গৃহস্থ বলে পরিচিত ফারুক মিয়া, সানোয়ার হোসেন, দুলাল মিয়া ও রুহুল আমিনের সঙ্গে। ছায়ার হাওরে দুলাল মিয়ার ডুবেছে ৯০ কানি, ফারুক মিয়ার ৪০ কানি, রুহুল আমিনের ৪১ কানি এবং সানোয়ার হোসেনের ৬০ কানি জমির ফসল।

এক কানি জমির ফসলও ঘরে তুলতে পারেননি তারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপদ দুলাল মিয়ার। ফারুক ও সানোয়ার নিজের জমি করলেও দুলাল মিয়া মূলত অন্যের জমি কন্ট্রাক্ট নিয়ে ধানের আবাদ করেন। এবারও প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে ৯০ কানি জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন। কিন্তু ঢল কেড়ে নিয়েছে তাদের সব ফসল। ঘরে এখন খাওয়ার মতো চালও নেই।

দুলাল মিয়া জানালেন, এবারের দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে তাদের মতো কৃষকরা। তাদের বড় সংসার। এই ধানের ‍উপর নির্ভর করেই তাদের সংসার। এ ধান বিক্রি করে চলে তাদের সারা বছরের বাজার সদাই, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ সবকিছু্। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, পরের বছরের আবাদের খরচ মেলা তো দূরে থাক এবার পেটের ভাতের চালই জুটবে না তাদের। সেক্ষেত্রে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের জীবন।

দুলাল মিয়ার ছয় মেয়ে। কারোরই বিয়ে হয়নি। এবার ধান কাটার পর এক মেয়ের বিয়ে দেয়ার কথা চিন্তা করেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন খাওয়ার ধানই নেই বিয়ের খরচ যোগাড় করবেন কোথায় থেকে। হয়তো এ বছর বিয়ে হবে না তার মেয়ের।

দুলাল, সানোয়ার এবং ফারুক জানালেন, কৃষ্ণপুর গ্রামে এবার সবচেয়ে বেশি জমিতে ধান যে কজন আবাদ করেছিলেন তাদের মধ্যে তারাই অন্যতম। কিন্তু এবারের ঢলে তাদের কোমর ভেঙ্গে গেছে। এই অবস্থা থেকে ঘুড়ে দাঁড়ানো সম্ভব কি না জানেন না তারা।

সানোয়ার মিয়া বললেন, যারা ক্ষুদ্র কৃষক কিংবা দিনমজুর পরিবার, তারা হয়তো হাওরে মাছ ধরে কিংবা কামলা বা জনমজুরি করেও সংসার চালাতে পারবেন। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন সাহায্যেও তারা অগ্রাধিকার পান বেশি। কিন্তু মধ্যম কিংবা তাদের মতো বড় গৃহস্থ যাদের এক একজনের ডুবেছে ৫০ থেকে ১০০ কানি ফসলি জমি, তারা তো সবকিছু থেকেই বঞ্চিত।

একদিকে মানসম্মানের ভয়ে তারা ভিজিএফ কার্ডের কিংবা ত্রাণের জন্য মেম্বার কিংবা চেয়ারম্যানদের কাছে তদবির করতে পারবেন না। অপরদিকে অনভ্যস্ততা কিংবা অভ্যাস না থাকার কারণে তারা জনমজুরি কিংবা ঢাকায় গিয়ে অন্য কাজও করতে পারবেন না। তাই সব দিক দিয়েই তাদের মরণ।

এ অবস্থায় তারা কৃষি ঋণ মওকুফের পাশাপাশি সরকারের কাছে নগদ প্রণোদনা চান।

ফারুক মিয়া জানালেন, নিজের জমিতে হোক বা পত্তনি নিয়ে হোক, যারা এবার ধান আবাদ করেছেন, এমন প্রকৃত গৃহস্থদের তালিকা তৈরি করে তাদের এবার সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। যদি এভাবে সরকার সহায়তা দেয় তবেই তারা আগামী বছর ফের জমিতে লাঙ্গল ছোঁয়াতে পারবেন। না হলে সামনের মৌসুমে টাকার অভাবে জমিতেই নামতে পারবেন না তারা। অনাবাদী পড়ে থাকবে তাদের জমি।

ইটনার একটি চায়ের দোকানে আলাপের সময় একই কথা জানিয়েছিলেন খালিয়াজুড়ির গাজীপুর ইউনিয়নের আজহারুল ইসলাম চৌধুরী। এবার ঢলে তার ডুবেছে ৯০ কানি জমির ধান। তিনিও শুনিয়েছিলেন তার মতো কৃষকদের কোমর ভাঙ্গার কথা।

সব মিলিয়ে এবারের ঢলে ধাক্কা লেগেছে হাওরাঞ্চলের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে। অন্যান্য বছর যারা হাজার হাজার মণ ধান মাড়াই করতেন, তাদের ঘরে এখন নেই এক মুঠো ধানও। প্রত্যেকেরই বড় বড় সংসার, অনেক ব্যয় দায়।

এসবের হিসাব তারা মেলাবেন কি করে? এখন এই চিন্তাতেই মশগুল, সানোয়ার, ফারুক, দুলাল কিংবা আজহারুল ইসলামের মতো গ্রামের অবস্থাপন্ন এই কৃষকরা।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩১ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৭
আরআই/জিপি

** ‘ছাবনি’ ধানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম রাজিয়া-নজরুলদের
** ‘দেহি যদি কিছু মেলে’
** প্রতি ওয়ার্ড-পরিবারে ওএমএস-ভিজিএফ চান চেয়ারম্যান সোহাগ
** হাওরের জলে অপরূপ সূর্যাস্ত
** নাড়ি ছেঁড়া ধনে টান কৃষকের
** হাওর ডোবার দায় নিলেন না কিশোরগঞ্জের পাউবো কর্তারা
** সরকার হাওরবাসীকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবে
** অকাল ঢলে ভাটির দেশে ‘অশনি সঙ্কেত’ এর পদধ্বনি

** হাওরের বুকে ‘কালবৈশাখী’ দর্শন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।