বিশাল এই হাওরের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে হয় বোরো ধানের আবাদ। হাওরের মাঝ বরাবর চলে গেছে সুরমার একটি শাখা।
সাধারণত বর্ষাকালে মাসের প্রায় ছয় মাস পানির নিচে তলিয়ে থাকে ছায়ার হাওর। এ সময় দিগন্ত বিস্তৃত উন্মুক্ত জলাশয়ে রূপান্তরিত হয় হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা। এক পাড় থেকে আরেক পাড় সহজে ঠাহর করা যায় না।
এই হাওরের জমি মূলত এক ফসলি। চৈত্র-বৈশাখ মাসের মধ্যেই হাওর থেকে সব ধান কেটে ঘরে তুলতে পারেন ছায়ার হাওরের কৃষক। সাধারণত হাওরে পানি আসে তারও পরে।
তবে এবার যেন উলট পালট হয়ে যায় সব হিসেব। ভারত থেকে অসময়ে নেমে আসা ঢলে স্বাভাবিক সময়ের প্রায় এক থেকে দেড়মাস আগে তলিয়ে যায় পুরো হাওর। অথচ পাকা ধান কাটার জন্য এ সময় অপেক্ষা করছিলেন হাওরের কৃষকরা। ছায়ার হাওরের প্রান্তে কৃষ্ণপুর গ্রাম। কৃষ্ণপুর ইউনিয়নে অবস্থিত জেলা পরিষদ ডাকবাংলার সামনে বসে এই গ্রামের কৃষক দুলাল, ফারুক বর্ণনা করলেন, কিভাবে তাদের চোখের সামনে ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যেই তলিয়ে যায় পুরো হাওর।
প্রতি বছর ছায়ার হাওরে পানি ঢোকে মূলত সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার দিক থেকে। আগাম ঢল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছায়ার হাওরের দিরাই ও শাল্লা উপজেলা প্রান্তে একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের। যার নাম ভেলানগরের বাঁধ। মূলত এবার এই ভেলানগরের এই বাঁধ ভেঙেই তলিয়ে যায় পুরো হাওর। ছায়ার হাওরে কৃষক ফারুক মিয়ার ডুবেছে ৬০ কানি জমির ফসল। দুলাল মিয়ার ডুবেছে ৯০ কানি জমির ফসল। (এক কানিতে ৪০ শতক জমি)।
ফারুক, দুলাল মিয়াসহ কৃষকরা জানান, তারা চেষ্টা করেছিলেন বাঁধটি বাঁচানোর। পানি আসার খবর পেয়ে তাদের গ্রামসহ আশপাশের উপজেলা গুলোর বিভিন্ন গ্রামের মানুষ হাজার হাজার মানুষ নিজেদের উদ্যোগেই ভেলানগর বাঁধে টেকানোর লড়াইয়ে শামিল হন। তবে বৃথা যায় তাদের প্রচেষ্টা। পাহাড়ি ঢলের পানির তীব্র তোড় ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের সব প্রচেষ্টা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তলিয়ে যায় পুরো হাওর। অবশ্য পানির তীব্র তোড়ের পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঠিকাদার এবং স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকাকেই বেশি দায়ী করলেন এই কৃষকরা।
তাদের দাবি ভেলানগরের বাঁধটির ভঙ্গুর পয়েন্টগুলো সংস্কারের জন্য আগের বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ হয়। তবে ঠিকাদাররা তাদের কাজ ঠিকভাবে করেননি। কয়েকটি পয়েন্টের মধ্যে ভেলানগরের পোতার মুখ বলে অবস্থিত একটি পয়েন্ট সংস্কারের জন্যই বরাদ্দ দেয়া হয়েছিলো ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু স্থানীয় ঠিকাদার ঠিকভাবে কাজ করেনি। প্রশাসনের তরফেও গাফিলতি আর হাওর এলাকায় অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণকেও দায়ী করেন তারা। কৃষ্ণপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি মোস্তাফিজুর রহমান রনি জানালেন, যদি স্থানীয় প্রশাসন আগে থেকেই পর্যাপ্ত বাঁশ, বালির বস্তা ইত্যাদির সঠিক যোগান দিতে পারতেন তবে গ্রামবাসীরা যেভাবেই হোক বাঁধটি বাঁচাতে পারতেন।
কিন্তু খালি হাত ও আর কোদাল দিয়ে লড়াই করে পানির স্রোত আর সময়ের বিরুদ্ধে টিকতে পারেননি তারা।
এছাড়া বাঁধ রক্ষার জন্য এক্সেভেটর বা মাটি কাটার মেশিন চাওয়া হয়েছিলো প্রশাসনের কাছে। এক্সেভেটর দিয়ে দ্রুত মাটি কেটে দুর্বল পয়েন্টগুলো সহজেই মজবুত করা যেত বলে জানালেন কৃষক ফারুক, সানোয়ার, নুরুল ইসলাম।
ভেলানগরের পোতার মুখে যেখানে বাঁধ ভেঙ্গেছে সেখানে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বাঁধটির উচ্চতা খুব বেশি নয়। প্রায় পানি ছুঁই, ছুঁই বাঁধের পিঠ। কোথাও বা আবার বাঁধ তলিয়ে গেছে পানির নিচে। জানা গেল বাঁধটির উচ্চতা ছিলো সর্বোচ্চ ছয় ফুট, কোথাও বা তিন থেকে চার ফুট। বাঁধের এত স্বল্প উচ্চতাও হাওর ডোবার অন্যতম কারণ বলে জানালেন তারা।
হাওরের পাড়ে অবস্থিত শাল্লার মাহমুদনগর বাজারে কথা হলো স্থানীয়দের সঙ্গে। তারাও জানালেন একই কথা। স্থানীয় বাসিন্দা ও শাল্লার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট অবনী মোহন দাশেরও অভিযোগ একই। সব মিলিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ, তাদের ঠিকাদার এবং প্রশাসনের গাফিলতিকেই হাওর ডোবার জন্য দায়ী করলেন ছায়ার হাওরের কৃষকরা।
বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৭
জেডএম/
** কোমর ভাঙলো হাওরের ‘বড় গেরস্থদের’
** ‘ছাবনি’ ধানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম রাজিয়া-নজরুলদের
** ‘দেহি যদি কিছু মেলে’
** প্রতি ওয়ার্ড-পরিবারে ওএমএস-ভিজিএফ চান চেয়ারম্যান সোহাগ
** হাওরের জলে অপরূপ সূর্যাস্ত
** নাড়ি ছেঁড়া ধনে টান কৃষকের
** হাওর ডোবার দায় নিলেন না কিশোরগঞ্জের পাউবো কর্তারা
** সরকার হাওরবাসীকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবে
** অকাল ঢলে ভাটির দেশে ‘অশনি সঙ্কেত’ এর পদধ্বনি
** হাওরের বুকে ‘কালবৈশাখী’ দর্শন