হাওরের প্রতিটি বাঁকই তার চেনা। এখানকার সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে তিনিই শিখিয়েছেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে।
ফেলে আসা শৈশবে হাওরের বুকে টানা ১৩ ঘণ্টা সাঁতার কেটেছেন। ভোট রাজনীতিতে ‘অপরাজেয়’ এ মানুষটিকে ভাটির লোকেরাই নাম দিয়েছেন ‘ভাটির শার্দুল’।
এখানকার মানুষের বুক উজাড় করা ভালোবাসায় তিনি কৃষকের সন্তান থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। তিনি রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ।
দলমত নির্বিশেষে হাওরের মানুষের কাছে তিনি শ্রদ্ধেয়, একান্ত আপনজন। সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত জীবন্ত এক কিংবদন্তি।
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন হাওরের দুর্গম বুক চষে বেড়িয়ে তাকে নিয়ে হাওরবাসীর এমন সম্বোধন ও অকৃত্রিম ভালবাসার গল্প শোনা গেছে।
রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের জন্মস্থান হাওর অধ্যুষিত জনপদ মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে। সময়টা ১৯৪৪ সালের পহেলা জানুয়ারি। পড়াশুনার হাতেখড়ি এখানকার স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬৯ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
ওই সময়টাতেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তার অভিষেক ঘটে। ১৯৬৩ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস এবং ঠিক দু’বছরের মাথায় ভিপি নির্বাচিত হন।
১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। ১৯৬৬ সালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন কারান্তরীণ ছিলেন তিনি।
১৯৭৫ সালে ঢাকা ল’ কলেজ থেকে এলএলবি পাস করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন অগ্নিসংগ্রামী হিসেবেও তার রয়েছে গৌরবগাঁথা ইতিহাস।
১৯৭০’র ঐতিহাসিক নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন আব্দুল হামিদ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি।
১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্তও ভোটে তিনি ছিলেন অপরাজেয়। জিতেছেন ’৭৯, ’৮৬, ’৯১, ’৯৬, ’২০০১ সালের নির্বাচনেও।
সপ্তম সংসদে ডেপুটি স্পিকার, নবম সংসদে বিরোধী দলের উপ-নেতার দায়িত্ব পালন করেন দক্ষতার সঙ্গে। ছিলেন মহান জাতীয় সংসদের স্পিকারও। নিরপেক্ষতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দীর্ঘদিন এ দায়িত্ব পালন করেছেন সফলতার সঙ্গেই।
স্বভাবসুলভ রসিকতায় সব সময়ই প্রাণবন্ত রেখেছিলেন সংসদকে। অর্জন করেছিলেন জনপ্রিয়তাও। এরপর দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও বর্তায় তার কাঁধেই।
স্পিকার থাকাকালে, এমনকি রাষ্ট্রপতি হয়েও হাওর অধ্যুষিত জনপদের বাসিন্দাদের টানেই সময় সুযোগ হলেই ছুটে যান তার নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন আর অষ্টগ্রাম উপজেলায়।
বিস্তীর্ণ হাওরের বুক ঘুরে দেখা গেলো, হাওরের প্রায় সব এলাকাতেই এখন রয়েছে ডুবো সড়ক। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব সড়ক আর ব্রিজ সহজ করে দিয়েছে হাওরবাসীর যাতায়াত।
রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে একাত্তরের রণাঙ্গন কাঁপিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আহাদ মাস্টার। তার বাড়ি অষ্টগ্রাম উপজেলার সদর ইউনিয়নের কলাপাড়া গ্রামে।
এখানকার আর সব বাসিন্দার মতো আলাপ আলোচনায় রাষ্ট্রপতির প্রসঙ্গ এলেই তার নাম উল্লেখ না করে তিনিও সম্বোধন করেন ‘মহামান্য’ নামে।
এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, মহামান্য’র মতো সৎ মানুষ বিরল। ভাগ্য বিড়ম্বিত হাওরবাসীকে তিনিই বেঁচে থাকার মন্ত্র শিখিয়েছেন। উন্নয়নের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন। মহামান্য সবার মন জয়ে করেছেন।
কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ ড. আমির উদ্দিন বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ চেনা গণ্ডির বাইরের একজন মানুষ। হাওরের বাতাস আর এখানকার জল-মাটির সোঁদা গন্ধ বরাবরই তাকে টানে। দেশের সর্বোচ্চ আসনে থেকেও তিনি নিজেকে একটুকুও বদলাননি। তিনি সততার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের স্মৃতি সব সময় জ্বলজ্বল করে। তার বৈশিষ্ট্য, সাফল্য আর কৃতিত্বের কথা এলাকার জনশ্রুতিতে যেন ঘোরে সব সময়।
কিশোরগঞ্জের নারী উদ্যোক্তা ও সরকারি রোটারি ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দা নাসিমা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ভাটির বাসিন্দা মহামান্য রাষ্ট্রপতি একজন দক্ষ সাঁতারু। শৈশবে একাধারে ১৩ ঘণ্টা তিনি সাঁতরেছেন। মিঠামইন বাজার থেকে সাঁতরে প্রায়ই বাড়ি ফিরেছেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাকস্ট্রোক সাঁতারেও প্রথম হয়েছিলেন। আর ফ্রি-স্টাইলে হয়েছিলেন দ্বিতীয়। তার এমন সাফল্যের কথা গর্বের সঙ্গেই স্মরণ করেন হাওরবাসী।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৭
এমএএএম/জেডএম