২৫ মে আইলার অষ্টম বর্ষ পূর্ণ হলেও এখনো সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলের লক্ষাধিক মানুষ। কাজ, খাবার ও সুপেয় পানির অভাবে আইলায় বিধ্বস্ত উপকূলীয় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
আইলা দুর্গত গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, খুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে বাস করছেন গৃহহীন মানুষ। লবণাক্ততার কারণে কৃষি কাজ নেই বললেই চলে। কর্মসংস্থানের খোঁজে এলাকা ছাড়ছেন অনেকেই। বেড়িবাঁধ ভেঙে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় জনপদ। সুপেয় পানির জন্য চলছে চরম হাহাকার। কোনো মতে দূর দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করে জীবন চলছে তাদের। নেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও।
বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট গোটা উপকূলজুড়ে। প্রচণ্ড লবণাক্ততায় জনপদ বৃক্ষরাজি শূন্য হয়ে পড়েছে। জ্বালানি, খাবার পানি ও কর্মসংস্থানের সংকট মানুষের জীবনযাত্রাকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে লোনা পানির চিংড়ি চাষ।
লবণাক্ততা মোকাবেলা করে কিছু জমিতে ধান চাষ সম্ভব হলেও অধিকাংশ কৃষি জমি রয়েছে অনাবাদি। কাজ ও জ্বালানি সংকটের কারণে সুন্দরবনের ওপর চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ।
সেই সঙ্গে বেড়েছে রোগ-শোক, অপুষ্টি, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে, যৌতুক ও শিশু শ্রম।
গাবুরার ইউসুফ আলী বাংলানিউজকে জানান, এলাকায় কোনো কাজ নেই। লবণ পানির চিংড়ি চাষ যতো বাড়ছে কাজ ততো কমে যাচ্ছে। লবণ পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে হবে। না হলে এই জনপদের মানুষ না খেয়ে মরবে। এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারবে না।
পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য দেবেন্দ্র নাথ মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ এখনো ঠিকমতো সংস্কার করা হয়নি। যতোদিন স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করা হবে, ততোদিন আইলার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে না। বার বার বাঁধ ভেঙে আমাদের সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। এলাকায় লবণ পানি ঢুকলে আর ফসল হয় না। মিষ্টি পানির আধারগুলোও লোনা হয়ে যায়। আর খাওয়ার পানি থাকে না।
চাঁদনীমুখা গ্রামের আছাদুল আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের নিরাপদ জীবনের জন্য সবার আগে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বাঁধ হলে যার যতোটুকু সম্পত্তি আছে তাতেই ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকতে পারবো। মিষ্টি পানির পুকুরগুলো আর নষ্ট হবে না। সেই পানি খেয়েই বাঁচবে মানুষ।
পানি কিনে খেয়ে কি জীবন চলে? প্রশ্ন করেন তিনি।
স্থানীয় পরিবেশ গবেষক মফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এলাকায় মানুষের মধ্যে তীব্র অপুষ্টি বিরাজ করছে। আইলায় খাদ্য নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়েছে। বর্তমানে কৃষকরা খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে লবণাক্ততা মোকাবেলা করে আবার ধান চাষের চেষ্টা করছেন। তাদের এ প্রচেষ্টায় সরকার সহযোগিতা না করলে কোনোদিনও তারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য স্থানীয় সরকারি খালগুলোর বন্দোবস্ত বাতিল করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ ও জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকায় কিছু ফলাতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
শ্যামনগর আতরজান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বাংলানিউজকে জানান, গোটা উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট। মানুষ পুকুরের পানি খেয়ে বেঁচে আছে। তাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তাই খাবার পানির সংকট নিরসনে এলাকার পুকুর-জলাশয়গুলো পুনঃখনন করে ব্যবহার উপযোগী ও মিষ্টি পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যতোদূর সম্ভব লোনা পানির চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে হবে। লবণাক্ততার কারণে মানুষ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান আলী আজম টিটু বাংলানিউজকে বলেন, শুধু গাবুরা নয়, উপকূলের লাখ লাখ মানুষের নিরাপদ জীবনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ। বার বার বাঁধ ভেঙে আমাদের সব অর্জন ম্লান করে দিয়ে যায়। খাবার পানিটুকুও থাকে না।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-০২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী অপূর্ব কুমার ভৌমিক বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-০১ ও ০২ এর আওতাধীন ১১টি পোল্ডারে ৮শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সে সময় ক্লোজ আপ দিয়ে পানি বন্ধ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে আইলা প্রকল্প শেষ হয়েছে। আইলা বিধ্বস্ত উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ীভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে সিআইপি (এডিপির একটি প্রকল্প) জরিপ করেছে।
২০০৯ সালের ২৫ মে ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস আইলার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকা। ১৫ ফুট উচ্চতায় ধেয়ে আসা জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায়। এতে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই ৭৩ জন নিহত হন। গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। ধ্বংস হয়ে যায় উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৮ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৭
এসআই