ওই ভূমিকম্পে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া রাজবাড়ি ফের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন রাজা প্রমোদ নাথ রায়। কিন্তু এবার রক্ষকরাই অবতীর্ণ হয়েছেন ভক্ষকের ভূমিকায়।
রাজবাড়িটিকে ১৯৬৭ সালে তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খান গভর্নরের বাসভবন হিসেবে ঘোষণা করলেও স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নাম দেন উত্তরা গণভবন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের উত্তরাঞ্চলীয় সচিবালয় হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয় উত্তরা গণভবনকে। কিন্তু সম্প্রতি গণপূর্ত বিভাগের কর্তাদের বাসভবন নির্মাণের জন্যই কাটা শুরু হয় প্রায় ৪৩ একর জায়গা জুড়ে গড়া রাজবাড়ি চত্বরের শতবর্ষী গাছ।
এসব গাছ কাটার ঘটনায় জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ ও স্থানীয় রাজনীতিকদের ত্রিমুখি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এলাকাবাসী মনে করছেন, শতবর্ষী বৃক্ষই এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ। তারওপর তড়িঘড়ি গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরুর আগেই মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গণপূর্ত বিভাগের চার কর্মকর্তার নামে।
কারো মতে, জেলা প্রশাসন গণভবনের কর্তৃত্ব নিজ আয়ত্ত্বে নেয়ার চেষ্টা করছে। কেউ ভাবছে, গণভবনের শতবর্ষী গাছ ও দিঘির মাছকে টার্গেট করে এগোচ্ছিলেন স্থানীয় রাজনীতিকরা। গাছ কাটার ঘটনা তাদের একটা টেস্ট কেস ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কয়েক দশক ধরে গণভবন চত্বরের শতবর্ষী বৃক্ষ, দিঘির মাছসহ সকল কিছু রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে গণপূর্ত বিভাগ। তাদের তত্ত্বাবধানে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে আনসার ও পুলিশ। প্রশ্ন উঠেছে, গণপূর্ত বিভাগের কর্মচারীদের আবাসন প্রশ্নে গাছ কাটার ঘটনাতেই তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি তোলা হচ্ছে কেন। এতো দিন জেলা প্রশাসন কেন নীরব ছিল!
এছাড়া ২০০৫ সাল থেকে গণভবনের ভিতরের লেক আর ইজারা দেয়নি গণপূর্ত বিভাগ। এরপর থেকে মংস্য বিভাগ সেখানে দেশি মাছের পোনা ছাড়লেও সেগুলোর কোন হদিসই নেই।
এসব নিয়ে গত ১৭ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় স্থানীয় এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের তোপের মুখে পড়েন জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ ও বন বিভাগের কর্তারা। সে সময়ই গণপূর্ত বিভাগের চার কর্মকর্তার নামে মামলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এছাড়া গণভবনের দুই তত্ত্বাবধায়ক আবুল কাশেম ও আব্দুস সবুর তালুকদারকে গণভবন ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তারা গণভবন ছাড়ার তিনদিনের মাথায় ফের ৭ দিনের জন্য গণভবনে ফিরে আসেন।
তবে তত্ত্বাবধায়ক আবুল কাশেম জানান, ভবন ছাড়ার দাপ্তরিক নির্দেশপত্র পাওয়ার পরপরই বৃহস্পতিবার রাতে ৯০ ভাগ মালামাল সরিয়ে নিয়েছেন। এরপরে তার পরিবারের কেউ ওই ভবনে ছিলেন না।
এদিকে গণভবনের গাছ কাটার ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার একাত্তর পরিষদ। পরিষদ সভাপতি কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, উত্তরা গণভবন একটি সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে কী ঘটছে তা মানুষ সহজে জানতে পারে না। সবে জানা গেছে, অবৈধ গাছ কাটা চলছে অনেকদিন ধরে। এই অপকর্মের দায়ভার গণপূর্ত বিভাগ, বন বিভাগ, জেলা প্রশাসন, ঠিকাদার এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের। অথচ তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
কলেজ শিক্ষক সাজেদুর রহমান সেলিম বলেন, এ ঘটনায় কোন চুনোপুটির নামে মামলা দিয়ে ঘটনার মূল হোতাদের বাঁচানোর চেষ্টা করলে নাটোরের মানুষ মেনে নেবে না। তারা জাতীয় ও বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন রক্ষায় উপযুক্ত পদক্ষেপের দাবি জানান।
এদিকে গঠিত তদন্ত দল গত শুক্রবার (২০ অক্টোবর) সকাল থেকে উত্তরা গণভবনে কর্মরত আনসার সদস্য, নিরাপত্তা রক্ষী, মালি ও গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। তদন্ত দলের সদস্য এনডিসি অনিন্দ্য মন্ডল তদন্ত কাজ শুরুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুল বাংলানিউজকে বলেন, গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসককে না জানিয়ে গাছ কাটা সঠিক হয়নি। এ ব্যাপারে গণপূর্ত বিভাগসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত কার্যক্রম শুরু করা হবে। তদন্তে যার নাম উঠে আসবে তার বিরুদ্ধেই মামলা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৭
জেডএম/