ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

দিনাজপুরের মহারাজা স্কুল ট্রাজেডি

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০১৮
দিনাজপুরের মহারাজা স্কুল ট্রাজেডি মহারাজা স্কুল ট্রাজেডির স্মৃতিস্তম্ভ

দিনাজপুর: দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় দিনাজপুর। দেশ স্বাধীনের পর ২০ ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন, লুকিয়ে রাখা ও ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র, বোমা ও গোলাবারুদ উদ্ধার করতে শুরু করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। উদ্ধারকৃত অস্ত্র মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থিত ট্রানজিট ক্যাম্পে জোড়ো করতে থাকেন তারা।

মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থিত ট্রানজিট ক্যাম্পে ভারতের পতিরাম, হামজাপুর, বাঙ্গালবাড়ী, তরঙ্গপুর, বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ, ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ী, হাকিমপুর, দিনাজপুর সদর, ঠাকুরগাঁও, পীরগঞ্জ, রাণীশংকৈল ও হরিপুর এলাকার ৬ ও ৭নং সেক্টরের প্রায় হাজার খানেক মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন।  

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষেরা আনন্দে আত্মহারা।

জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখ দুপুর গড়িয়ে বিকেলের সূর্যটা পশ্চিম প্রান্তে হেলে নিস্তেজ প্রায়। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে ৫টার দিকে। এমন সময় নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট থেকে উদ্ধার্কৃত দুই ট্রাক অস্ত্র মহারাজা স্কুলে নিয়ে আসেন মুক্তিযোদ্ধারা।  

একটি ট্রাক খালাসের পর অপর ট্রাকটি খালাসের এক পর্যায়ে হাত বদলের সময় একটি মাইন মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় বাংকারে স্তূপীকৃত বিপুল মাইন, বোমা, বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বিদ্যালয়ের কক্ষে ও মসজিদে নামাজ আদায়কারী মুক্তিযোদ্ধারা নিহত হন। বাংকার সংলগ্ন এলাকা ২০ থেকে ২৫ ফুট গভীর পুকুরে পরিণত হয়। যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। নিহতদের অনেকের মরদেহ ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে যায়। সেদিন চিহ্নিত করা যায়নি অনেক মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ।

পরদিন দিনাজপুরের ঐতিহাসিক গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে ৯৬ জন মুক্তিযোদ্ধার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ পূণ্যভূমি দিনাজপুর চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। পরে একই স্থানে আরো ৩৯ জনসহ মোট ১শ’ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ সমাহিত করা হয়। এছাড়া অনেক মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ তাদের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান।  

ঘটনার পরদিন আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ ছিন্ন-বিছিন্ন হওয়া হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক ওজন হয় প্রায় ৫০ মনের মতো। আর এ কারণে নিহতের সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

দিনাজপুর শহরের দক্ষিণ বালুবাড়ির বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, দেশ তখন স্বাধীন, দেশের সকল মানুষ আনন্দে আত্মহারা। ঠিক এই মুহূর্তে এই নির্মম দুর্ঘটনা যেন আনন্দের মধ্যে ভাটা নিয়ে আসে। মহারাজা স্কুলে বিস্ফোরণের ঘটনায় ক্যাম্পে অবস্থানরতদের দেহ ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে যায়। ঘটনার পরদিন আমরা নিহতদের ছিন্ন-বিছিন্ন শরীরের অংশ সংগ্রহ করতে শুরু করি। এ সময় কারো হাত পাওয়া গেছে বাড়ির ছাদে, কারো পা পাওয়া গেছে এক কিলোমিটার দূরের খোলা মাঠে। নিহতদের ছিন্ন-বিছিন্ন অবশিষ্ট অংশ প্রায় ৫০ মণ ওজন হয়। যা পরে একত্রিত করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও শরীর কেঁপে ওঠে।

মহারাজা স্কুল ট্রাজেডি দিবসটি পালন উপলক্ষে দিনাজপুরে ৬ জানুয়ারি স্মৃতি পরিষদ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকালে চেহেলগাজী মাজার প্রাঙ্গণে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণসমাধি ও মহারাজা স্কুলের শহিদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ। পরে দিনাজপুর প্রেসক্লাবে আলোচনা সভা ও বাদ আসর মহারাজা স্কুল জামে মসজিদে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।

বাংলাদেশ সময়: ০১১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০১৮
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।