অস্ত্রহাতে সম্মুখ সমরেও অংশ নেওয়া এই বীর নারীর জন্মস্থান সুনামগঞ্জে ভারতের সীমান্তঘেঁষা ভুগলা ইউনিয়নের ক্যাম্পেরঘাট এলাকায়। স্বামী সাহেদ আলীসহ পরবর্তীতে বসতি গড়েন দোয়ারাবাজার উপজেলার ৭ নম্বর লক্ষীপুর ইউনিয়নের জিরারগাঁওয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পর যুদ্ধে বীরত্বগাঁথা অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৬ সালে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। কিন্তু গেজেট আকারে প্রকাশ না পাওয়ায় জীবদ্দশায় খেতাবের বিপরীতে সুবিধা ভোগ করে যেতে পারেননি কাকন বিবি। তার একমাত্র মেয়ে সখিনা বিবিও সেই সুবিধা পাবেন কি না এ নিয়ে সন্দিহান মুক্তিযোদ্ধারা।
যুদ্ধদিনে কাকন বিবির সেই অসীম সাহসিকতার বর্ণনা দিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ভবতোষ বর্মণ।
তিনি বলেন, কাকন বিবির যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো ৫ নম্বর সেক্টরে। আমার যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো ওই সেক্টরের ৪ নম্বর সাব সেক্টরে। একাধিকবার পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়ে নির্মম নির্যাতনের পরও পিছপা হননি এই অগ্নিকন্যা।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাক সেনাদের অভ্যন্তরের খবর এনে দিয়েছেন কাকন বিবি। তার তথ্যের ভিত্তিতেই অনেক যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করেন।
রণাঙ্গনে তার সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেওয়া অনেক মুক্তিযোদ্ধার মুখে তার ভূয়সী প্রশংসা শুনেছি মন্তব্য করে ভবতোষ বলেন, তার মতো যোদ্ধাদের কারণে বাংলাদেশ ৯ মাসে স্বাধীন হয়েছে। এসব ব্যক্তিত্বের সঠিক মূল্যায়ন না হলে দেশের যে কোনো দুর্যোগে কেউ এগিয়ে আসবে না।
কাকন বিবির বীরপ্রতীক খেতাব গেজেটভুক্ত না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক মন্তব্য করে মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ বর্মণ বলেন, বীরপ্রতীকে ভূষিত হলেও সে সুবিধা ভোগ করে যেতে পারেননি কাকন বিবি। তার পরিবার-পরিজনদের যারা বেঁচে আছেন, তারাও সেই সুবিধা ভোগ করতে পারবে কিনা সন্দিহান তিনি।
সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, বিগত দিনে যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে সেসব অপতৎপরতাকারীদের মুখে চুনকালি দিয়ে এসব বীরদের মূল্যায়ন করার দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে ভবিষ্যতে পৃথিবীর বুকে ‘আমরা সেরা জাতি’ তা প্রমাণ করা আরও কষ্টসাধ্য হবে।
মাকে হারিয়ে শোকে কাতর সখিনা বিবি বলেন, মা চলে গেছেন, এ ভুবনে আর কেউ নেই। প্রধানমন্ত্রীকে ‘বোন’ আখ্যায়িত করে তার প্রতি সদয় হওয়ার আর্তি জানান তিনি।
কাকন বিবির স্বামী সাঈদ আলীও প্রয়াত। জীবদ্দশায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া একখণ্ড খাস জমিতে মেয়ে সখিনা ও মেয়ে জামাতা রফিক মিয়াকে নিয়ে ছোট্ট কুঁড়েঘরে বসবাস করতেন কাকন বিবি।
১৯৭১ সালে তিনদিন বয়সী মেয়ে সখিনাকে রেখে যুদ্ধে চলে যান কাকন বিবি। জুনে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন তিনি। বাঙ্কারে আটকে দিনের পর দিন তাকে নির্যাতন করে পাকিস্তানি সেনারা।
ছাড়া পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন। রহমত আলীর দলের সদস্য হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ করেন তিনি। একইসঙ্গে চালিয়ে যান গুপ্তচরের কাজ।
সাহসী এই নারী সুনামগঞ্জের আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বলিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, আধারটিলাসহ প্রায় ৯টি সম্মুখযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন।
বুধবার (২১ মার্চ) রাত ১১টা ৫ মিনিটে তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর।
গত সোমবার (১৯ মার্চ) সন্ধ্যায় নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি কেবিনে ভর্তি হন তিনি। এরপর তাৎক্ষণিভাবে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়।
এর আগে ২০১৭ সালের ২১ জুলাই মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়ে ওই হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।
**নিজ গ্রামে পৌঁছেছে কাকন বিবির মরদেহ
**মাকে হারিয়ে শোকে কাতর সখিনা বিবি
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৮
এনইউ/আরআর