এই আক্ষেপ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ মনভরণ রায়ের স্ত্রী রাজকুমারীর। ৮৫ পার করে ৮৬ বছরে পা রেখেছেন।
অশীতিপর রাজকুমারীর পরিবারের নয় সদস্য। দুই ছেলে ও তাদের দুই বউ আর চার নাতি-নাতনী। নয়জন মিলে থাকেন জগন্নাথ হলের কর্মচারীদের জরাজীর্ণ টিনশেড ঘরের দু’টি কক্ষে। বড় ছেলের নাম বিন্দু রায় (৫০), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করছেন। আর তার ছোট বিমল রায় (৫০) কাজ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ বিভাগে। টানাপোড়েনের সংসারে বিন্দু রায়ের ছেলে দেবাশীষ রায় বোরহান উদ্দীন ডিগ্রি কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। আর মেয়ে সুজিতি রায় পড়ছেন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের দশম শ্রেণিতে। বিমল রায়ের ছেলে অমিত রায় বোরহান উদ্দীন কলেজেরই দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। আর মেয়ে প্রমিতা রায়ও পড়ছেন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে।
সেই টিনশেড ঘরে গিয়েই বাংলানিউজ শুনে আসে রাজকুমারীর দুঃখ-আক্ষেপের কথা। বয়সের কারণেই রাজকুমারীর সব কথা বোঝা বোঝা যাচ্ছিল না। আধো-আধো কথায় কথায় যা বললেন, তাতে বেশ ক্ষোভই প্রকাশ পেলো।
রাজকুমারী সে রাতে স্বামী হারানোর শোক ভুলেছেন দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে। তবে যে পরিবারের ত্যাগের বিনিময়ে দেশ হয়েছে স্বাধীন, তাদের খোঁজ রাখেনি কেউ। পরিবারটির প্রাপ্তি বলতে ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া দুই হাজার টাকা।
রাজকুমারী বলছিলেন, ‘আমাকে তো ভাতা দেওয়া দরকার। আমার খাওয়া, চিকিৎসা দরকার। সবসময় অসুস্থ থাকি। প্রতিবছর বিভিন্ন চ্যানেলে আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছে, ইন্ডিয়ার চ্যানেলও আসছিল। কিন্তু আমাদের কোনো কিছু হলো না। ’
যারে পাইছে তারে মারছে
গণহত্যার রাতের কথা স্মৃতিপটে ভাসলে এখনও আঁতকে ওঠেন রাজকুমারী। মনভরণ কাজ করতেন নিপা ভবনে (এখনকার কমার্স ফ্যাকাল্টি বিল্ডিং) ম্যাসেঞ্জার পিয়ন হিসেবে। সে হিসেবে জগন্নাথ হলের কর্মচারীদের হলে থাকতেন পরিবার নিয়ে।
রাজকুমারী বলছিলেন, ‘২৫ তারিখ রাত ১২টা কি সাড়ে ১২টা। তখনো ঘুমাই নাই। রাতে ভাত খেয়ে বাসন-কোসন ঠিক করতেছিলাম। পোলাপাইন কান্নাকাটি করে। কেউ জাইগা আছে, কেউ ভাত খায়তেছে- এই অবস্থায় হলে আইসা (পাকিস্তানি) মিলিটারি গোলাগুলি শুরু কইরা দিছে। আমার স্বামীরে বাসা থেইক্যা ধরে নিয়া গেছে। আমগোরেও বলেছে, এখান থেকে সরবানা, আমরা আইতাছি। রাত্রে গোলাগুলি করছে, যারে পাইছে তারে মারছে। আর সকালেও যারে পাইছে তারে ধরেছে। ধরে নিয়ে যাওয়া লোকদের দিয়েই রাতের ডেডবডিগুলো শহীদ মিনারের সামনে জড়ো করেছে। এরপর সবাইকে লাইনে দাঁড়াতে বললো। আমরা দূর থেকে দেখছিলাম, তখন অনেকে মাফ চাইতেছিল। কিন্তু কোনো কতা না শুনে লাইনে দাঁড়ানো ৬০-৭০ জনকে এক লগে ব্রাশ (বার্স্ট) ফায়ার করে দিসে। ’
সেখানে ছিলেন মনভরণও। হলের ভেতরে একটা ভাঙা গোয়ালঘর থেকে রাজকুমারী আর শাশুড়ী দেখেছেন পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মমতার চিত্র। চোখের সামনে দেখতে হলো, দেয়াল ভেঙে ট্যাংকসহ ভেতরে প্রবেশ করা সেনাবাহিনীর হাতে স্বামীসহ অন্যান্যদের করুণ পরিণতি। গুলি করার সে দৃশ্য দেখে ‘আমার ছেলেরে মাইরা ফেলছে’ বলে চিৎকার করেছিলেন তার শাশুড়ী। কিন্তু শাশুড়ীকে চিৎকার করতে না দিয়ে রাজকুমারী তখন বলছিলেন, ‘চিৎকার দিয়ো না, ফিরা (ফিরে) আইসা আমাগোরে গুলি করবো। আইসা পড়ো, আইসা পড়ো। ’
নির্মমতার চিত্র চোখে ভাসে রাজকুমারীর। বলেন, ‘তখন সকাল ১১টা কি ১২টা হবে। দেখি লাশের ওপার (যেখানে মরদেহ রাখা হয়েছিল) থেইকা ওরাই চিৎকার দেয় (যারা তখনও বেঁচে) ‘অই অই জল খাওয়াও, জল খাওয়াও। ’ রইদও (রোদ) ছিল সেদিন কঠিন রইদ। পরে আমি, আমার শাশুড়ী আর অন্যেরা সবাই ঘটি (পাত্র), গিলাস (গ্লাস) নিয়ে দৌড়াইতেছি জল নিয়া। যারা বাঁইচা আছিল, তারা একটু জল খাইছে। খাওয়ার পরে পরে মারা গেছে অনেকে। আমার স্বামীও তখনো বেঁচে। এতো রক্ত, সারা শরীর রক্তে লাল হয়ে গেছে। ’
রাজকুমারী স্মরণ করেন, অন্তিম মুহূর্তে ছেলেদের দেখার আকুতি নিয়ে মনভরণ তার মাকে বলেছিলেন, ‘একটা কাজ কর না মা, আমার বাচ্চাগুলারে দেখাইয়া দাও। আমি ত বাঁচবো না। আর আমার কথা বলে ওইখানে নিয়ে চল’। মা যখন তার সন্তানদের নিয়ে এলেন, তখন মনভরণ রায় মুমূর্ষু প্রায়। তিনি তখন বলেন, ‘তোমরা আর এখানে থাইকো না। আবার আসলে তোমরারে (তোমাদের) মাইরা ফেলবো ওরা। এইখান থেকে পলাইয়া যাও। ’
সবাইকে নিয়ে রাজকুমারী চেয়েছিলেন মনভরণকে মরদেহের স্তূপ থেকে সরিয়ে আনতে। কিন্তু হানাদারদের ভয়ে সবাই চাপাচাপি করছিল বিধায় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে করতে একসময় নিথর হয়ে যান মনভরণ। এই কষ্ট আজও ভুলতে পারেন না রাজকুমারী।
শাশুড়ী-সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর স্মৃতিও ভুলতে পারেন না মনভরণের স্ত্রী, ‘আমরা তখন যাইতে যাইতে হোসনি দালান গেছি। সেখানকার লোকজন বললো, তোমাদের পাইলে গুলি কইরা দিবো। ওরা (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) এখানে দুই-তিনবার গাড়ি নিয়ে আসে। তোমরা পালাও, পিছনে (হোসনি দালানের) পালাও। পরে আমরা পিছনের দিকে আশ্রয় নিই। ওখানে আমাদের পরিবারসহ অনেকেই ছিল। ছেলেদের রাখত না। ওখানে রাইত ছিলাম। তারপর ওরা বলল এখান থেকে পালাও, তোমাগোরে দেখলে আমাদেরও মারবো। বললাম আমরাতো কিছু চিনি না। অনেকে বলছে, আবার জগন্নাথ হলে যাই। কেউ কেউ বললো, না আর যাবো না। চলো, কারো বাড়ি ঘরে ঢুইক্যা পড়ি। কেউ বলছে কারো বাড়ি ঘরে ঢুকতে দিবো? কতগুলো মহিলা জানালা দিয়ে আমাগো দেইখ্যা নিচে আসলো। বলল কী ঘটনা? আমি কই সবার গায়ে রক্ত মাখা- বললাম এই এই ঘটনা। আমরা কোথায় যাই? কী করি? ‘তখন তারা (বাড়ির লোকজন) বলে, দ্যাখো আমরা তো তোমাগোরে রাখতে পারবো না। আইলে আমাগোরেও গুলি কইরা দিবো। ওই যে একটা বাড়ি বানাইতাছে ওইটাতে গিয়া আশ্রয় নাও। ’
সেই বাড়িটা ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পানির ট্যাংকের কাছে। রাজকুমারীর পরিবারকে সেখানে ঢুকতে দিয়ে দারোয়ান বলেছিলেন, রাত থাকলেও সকালে যেন চলে যায়। তখন রাজকুমারীর পরিবারসহ শ’খানেক লোক সেই বাড়িতে আশ্রয়ে ছিলেন। বেশিরভাগই ছিলেন জগন্নাথ হল থেকে যাওয়া। ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের পাশে একটা কক্ষে ছিলেন রাজকুমারীরা। যেখানে মানুষের হাড্ডি-মুণ্ডু পড়েছিল।
রাজকুমারীর মনে পড়ে, ‘ব্যাটারা বলেছিল, এখানে শুয়ে পড়ো। সেখানে আমরা ৩-৪ দিন ছিলাম। রোগীর খানাপিনা আইন্যা পোলাপাইনগো দিয়েছিল। পরে সেখান থেকে বের করে দিলে আমরা গেছি পুরান ঢাকায়। মিরিঞ্জা এলাকায় সুইপার কলোনিতে। ওরা খুব যত্ন করেছিল। আমাগোর দেইখ্যা অনেক কান্নাকাটি করেছিল। ওখানে ছিলাম কয়েকদিন। এরপর ঘোষপট্টিতে গিয়ে অনেকদিন ছিলাম। সেখান থেকে বিক্রমপুরে (মুন্সীগঞ্জ) চলে যাই আমরা। ’
দীর্ঘ ন’মাস যুদ্ধ হয়। ৩০ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এবার শুরু হয় রাজকুমারীর নতুন যুদ্ধ, সন্তানদের নিয়ে বাঁচার যুদ্ধ। বিক্রমপুর থেকে ফিরে আসেন ঢাকায়। অনেক কষ্টের পর জায়গা হয় জগন্নাথ হলের কর্মচারী নিবাসেই। পরে দুই সন্তানকে চাকরি দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তার ভাষ্যে, প্রতিবছর ২৫ মার্চের আগে পত্রপত্রিকায় কালরাতের স্মৃতিচারণ স্বরূপ তাদের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ওই দুই হাজার টাকা ছাড়া আর কেউ কিছু দেয়নি। দুঃখ-কষ্টের কথা বলতে বলতে ক্লান্ত বলে এখন আর এসব বলতেও চান না। রাজকুমারী বলেন, ‘কী হবে বলে? কেউ কি কিছু করবে?’
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
এসকেবি/এইচএ/