কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে অচলাবস্থার অবসান না হওয়ায় ঢাকায় যে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তা দেখে বঙ্গবন্ধু ওই দিন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলেন। এমনকি আক্রান্ত হলে সতর্ক ও নিরাপদে থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলারও নির্দেশনা দেন, বলে দেন স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও।
শেষ পর্যন্ত হলোও তা-ই। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালির ওপর চালায় ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা, যার নাম তারা দেয় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। সেই ‘অপারেশন সার্চ লাইট’র নামে চালানো গণহত্যাযজ্ঞের ৪৭তম বার্ষিকী রোববার (২৫ মার্চ)। এদিন জাতীয়ভাবে উদযাপন হবে গণহত্যা দিবস। এটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার আহ্বানে রোববার ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত আলো নিভিয়ে পালন করা হবে নীরবতা।
গণহত্যার রাত ও এর আগের প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা হচ্ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা তৎকালীন কয়েকজন ছাত্রনেতার সঙ্গে। তারা বলছিলেন, ১ মার্চের পর থেকে, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পর যে কোনো দিন যে কোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালির ওপর আক্রমণ করতে পারে, এটা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। ২৫ মার্চ সারাদিনই একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিলো। অন্যান্য দিনের মতো ওই দিনও সভা, সমাবেশ, মিছিলের কর্মসূচি চলছিলো। দুপুরের পর থেকেই আরও স্পষ্ট হয়ে যায়, রাতে একটা আক্রমণ হতে পারে।
তৎকালীন ওই ছাত্রনেতারা জানান, ২৫ মার্চ রাতের পরিস্থিতিটা সর্বস্তরের মানুষও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। মানুষের মধ্যে একটা ভয়-আতঙ্কও ছিলো। তবে এই ভয়-আতঙ্ক দূর করার জন্য এবং মানুষকে উজ্জীবিত রেখে যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আগে থেকেই প্রতিদিন সভা-সমাবেশ-মিছিলের কর্মসূচি নেওয়া হতো। ওই দিনও সেটা চলছিলো। পরিস্থিতি চূড়ান্তভাবে বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু সন্ধ্যার পরই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলেন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেন। সন্ধ্যার পর যারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি তাদেরই এই নির্দেশ দেন।
ওই দিনের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী বাংলানিউজকে বলেন, ১ মার্চ (প্রেসিডেন্ট) ইয়াহিয়া খানের ঘোষণায় ৩০ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে যায়। তখনই আমরা বুঝতে পারি যে কোনো সময় যে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। দেশ দাবানলের মতো উত্তপ্ত হয়ে যায়। ১ মার্চই স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আমরা প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে সভা, সমাবেশ, মিছিল সংগঠিত করেছি। এর মূল কারণ ছিলো মানুষ যেন ভীত না হয়ে পড়ে, যেন সবসময় উজ্জীবিত থাকে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে দেন। তবে সাংবিধানিক রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণে বঙ্গবন্ধু যে কথাটি বলতে পারতেন না, সেটা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচিতে আমাদের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হতো। সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ২৫ মার্চ আমরা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে অবাঙালিদের কাছ থেকে সংবাদ পেলাম তারা চলমান অসহযোগ আন্দোলনে সমর্থন দেবে। এই ২৫ মার্চেই জনতা ব্যাংক শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের সামনে আমি স্পষ্টভাবে বলে দিই, এটাই আমার পূর্ব পকিস্তানে শেষ বক্তৃতা। খুব শিগগির আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে বক্তৃতা করবো। ওই দিন মানুষের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্কও দেখা যায়। সন্ধ্যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাই। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে অবাঙালিদের আমাদের প্রতি সমর্থনের কথা শোনালেন। তিনি আমাদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে বললেন। আমরা জানতাম ২৫ মার্চ, ২৬ মার্চ আর ২৭ মার্চ হোক, যে কোনো দিন একটা ঘটনা ঘটবে, বাঙালির ওপর আক্রমণ হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি এবং ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ১ মার্চ থেকেই অন্যান্য দিনের মতোই ২৫ মার্চেও জনগণের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা এবং পাকিস্তানবিরোধী জাগরণ অব্যাহত ছিলো। মানুষের মধ্যে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার শেষ পরিণতি কী হয়, তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা থাকলেও প্রায় সবাই পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছিলো পরিস্থিতি অচলাবস্থা ও চূড়ান্ত সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। অন্যান্য দিনের মতোই ওই দিনও ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে হাজার হাজার তরুণ বিভিন্ন ব্রিগেডে ভাগ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে কুচকাওয়াজ করে। ঢাকায় সেনাবাহিনী নামলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিলো।
সেলিম বলেন, ছাত্র ইউনিয়নের বড় একটি দলকে রাইফেল ও তাজা বুলেটসহ ফায়ারিং প্রশিক্ষণের জন্য নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি জনশূন্য এলাকায় পাঠানো হয় ওই দিন। দুপুরের পরে আমরা অনুমান করতে শুরু করি আজ রাতটা ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যদিয়ে পার হবে। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র ইউনিয়নের গণসমাবেশে সবাইকে বলে দেওয়া হয় রাতে সতর্ক থাকতে। ছাত্র নেতাকর্মীদের রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে নিষেধ করা হয়। রাত সাড়ে ১০টা-১১টার দিকে সেনাবাহিনী আক্রমণ শুরু করে। আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ শুরু করি। কয়েকটি জায়গায় ব্যারিকেড দেই। সেনাবাহিনী গুলি বর্ষণ শুরু করে। আমরা হাতিরপুল এলাকায় কেরোসিন, পেট্রোল, ড্রাম জোগাড় করে ককটেল বানানো শুরু করি। কিন্তু যখন ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শুরু হয়ে যায়, তখন বুঝতে পারি আমাদের কাঁচা হাতের এই প্রস্তুতি দিয়ে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করা কঠিন। আমার যতটুকু মনে পড়ে, ওই দিনের প্রথম আক্রমণ বাংলা মোটর ও গ্রিন রোড এলাকায় হয় এবং সেখানে অনেক যোদ্ধা শহীদ হন।
জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি শেখ শহীদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ২৫ মার্চ সারাদিন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিলো। আলোচনা ব্যর্থ বোঝা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিলো, যে কোনো সময় যে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে, তাই রাতে সবাইকে একসঙ্গে খাবার খেতে। ওই দিন রাতে খাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বললেন তোমরা দ্রুত বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। সন্ধ্যার পর রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্রনেতারা যারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাদের সবাইকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি সতর্ক করেছিলেন যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, আক্রমণ হতে পারে। প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা বেরিয়ে গেলাম।
‘আমি আবার রাত ১১টার পর ৩২ নম্বরে গিয়েছিলাম। বাসায় ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে ধমক দেন, এখনও এখানে কী করছো? আমি দ্রুত বেরিয়ে যাই। এর কিছুক্ষণ পরই বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। ২৫ মার্চ সারাদিনই মিছিল, সভা, সমাবেশ হয়েছে। আমিও ওই দিন গাজীপুরে একটা কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ঢাকায় আসি। সন্ধ্যার পর বোঝা গেলো আজই ক্র্যাকডাউন হবে। এটা আঁচ করতে পেরে প্রতিরোধ গড়ে তোলারও প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ছাত্র-জনতা ব্যারিকেড বসিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু করেছিলো। ’
২৫ মার্চ রাতে যে রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানি হানাদাররা, সেই রক্তের বদলা নেওয়ার শপথে বাংলার দামাল ছেলেরা গড়ে তোলে চূড়ান্ত প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধে নয় মাস টিকতে পেরেছিলো অস্ত্রবাজ পাকিস্তানিরা। ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে উদিত হয় নতুন একটি সূর্য, বিজয়ের সূর্য। পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নেয় আরেকটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩২ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
এসকে/এইচএ/