শুক্রবার বিকেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের বাগডোরা মধ্যপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ আব্বাস উদ্দিন।
আব্বাস উদ্দিন জানান, ত্রিশ বছর আগে বিশাল জোতদার ছিলেন তিনি।
বার্ধক্যে এসে ছেলেদের আয়ে গত বছর দেড় লাখ টাকায় ১২ শতাংশ জমি কিনে বাগডোরা মধ্যপাড়ায় বসতভিটা তৈরি করেন আব্বাস উদ্দিন। সেটাও বৃহস্পতিবার (৩০ আগস্ট) মধ্যরাতে তিস্তার ভাঙনের কবলে পড়ে। একটি ঘর ভেসে গেলেও বাকি ঘরগুলো নিরাপদে সড়াতে পেরেছেন। কিন্তু বসতভিটা তৈরির জায়গা নেই। রাস্তার ধারে ফেলে রেখেছেন। পরিবারকে পাঠিয়েছেন নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে। এক সময়ের জোতদার হলেও এখন ঘর দাঁড় করানোর জমিও নেই আব্বাস উদ্দিনের।
একই গ্রামের দিনমজুর কালাম মিয়া (৫০) ১০ বারের মত এক চালা টিনের ঘর করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। তার বেড়ার নিচে তিস্তার হিংস্র স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। পানি আঘাত হানছে তার এ শীর্ন ঘরে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধটি রক্ষায় যত সামান্য কিছু জিও ব্যাগ ফেলে আপাতত রক্ষার চেষ্টা করেছেন। সেই ভরসায় পরিবার পরিজন নিয়ে আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে কালামদের।
কালাম মিয়া বাংলানিউজকে জানান, ঘরটা সড়ায়ে রাখার জায়গা নেই। তাই অনিরাপদ হলেও নদীর কিনারে থাকছেন তারা। রাতে স্বামী-স্ত্রী পালাক্রমে পাহারা দেন।
বাগডোরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেওয়া গৃহবধূ মৈরন বেগম (২৮) বাংলানিউজকে জানান, গত ঈদের দিন তাড়াহুড়া করে ঘর দুইটি সড়ায়ে রাস্তায় নিয়েছেন। একটি ঘর জায়গার অভাবে পাশে ডোবায় ফেলে রেখেছেন। একটি ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারিভাবে কোনো সহায়তা পাননি বলে দাবি করেন তিনি।
আব্বাস উদ্দিন, কালাম বা মৈরন নন, গত এক মাসে বাগডোরা মধ্যপাড়া গ্রামে প্রায় অর্ধশত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে রাস্তায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। জায়গার অভাবে কিছু পরিবার সব কিছু বিকিয়ে দিয়ে কাজের সন্ধানে পরিবার পরিজনসহ পাড়ি জমিয়েছেন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়। কেউ আবার আত্মীয়ের বাঁশ বাগান বা ডোবা উঁচু করে, কেউ দাদন ব্যবসায়ীদের চরা সুদে ঋণে জমি বন্দক নিয়ে নতুন স্বপ্ন বাঁধছেন। কেউ রয়েছেন খোলা আকাশের নিচে।
বাগডোরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বেড়িবাঁধটি রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে কালমাটি সলেডি স্প্যার বাঁধ অকার্যকর হয়ে পড়বে। তিস্তা নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে আদিতমারী উপজেলার ভাদাই সতি নদি হয়ে সাপ্টিবাড়ি ইউনিয়ন হয়ে জেলা শহরে চলে যাবে। এতে কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসলও জলাবদ্ধতায় বিনষ্টের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি পানি উন্নয়ন বোর্ড তিন হাজার জিও ব্যাগে জোড়া তালি দিয়ে দায়সাড়া কাজ করেছেন। সামান্য পানি বাড়লে এসব জিও ব্যাগ বসে যাচ্ছে। এ জন্য আরো তিন হাজার জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধটি রক্ষার জোর দাবি জানান তারা।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা বাহাদুরপাড়া গ্রামের গরিবুল্লাটারী পাড়াটি গত এক সপ্তাহে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। গত রাতে সর্বশেষ মাজেক মিয়ার বসতভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাহাদুরপাড়া মসজিদ, ব্রিজ কালভার্টসহ কয়েক হাজার পরিবার। ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে এলাকাবাসী মানববন্ধন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
ওই গ্রামের কলেজছাত্রী জাকিয়া ফারহানা বলেন, তিস্তার তীরবর্তীদের জনবিপর্যয়ে রেখে উন্নত দেশ গড়া সম্ভব নয়। তিস্তায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দিলে চরাঞ্চলের মানুষ বোঝা না হয়ে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। এ জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দফতরের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আজাহারুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, চলতি মৌসুমে তার ইউনিয়নে ১৩০টি পরিবারের বসতবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তালিকা দিয়ে ঢেউটিন ও টাকার চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ বাংলানিউজকে জানান, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে ঢেউটিন ও নগদ টাকা বিতরণ করা হবে। ভাঙন রোধে কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এছাড়াও জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভাঙন কবলিত এলাকায় নিয়মিত খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৮
আরএ