বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। হর্ন বাজিয়ে বিভিন্ন যানবাহন কেবল সাধারণ সড়ক নয়, নীরব এলাকা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি আবাসিক এলাকায়ও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের শব্দসন্ত্রাসে মানুষের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। শব্দ দূষণের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি কমছে, বাড়ছে বধিরতা ও হৃদরোগসহ নানা রোগের উপসর্গ। খিটখিটে হয়ে উঠছে মেজাজ-মর্জি। এসব থেকে মুক্তি পেতে ডাক্তারের কাছে ঢালতে হচ্ছে রক্ত ঘামানো অর্থ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু এবং বয়স্করা। স্থানীয়রা এজন্য দুষছেন ট্রাফিক ব্যবস্থাকেই।
বৃহস্পতিবার (৬ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে শিরোইল পুরাতন বাস টার্মিনাল, ঢাকা বাসস্ট্যান্ড, ভদ্রা বাসস্ট্যান্ড, নওদাপাড়া বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বিকট শব্দে বাস-ট্রাকগুলোকে হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে চলতে দেখা গেছে। শুধু বাস-ট্রাকই নয় মাইক্রো ও কারসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনও পিছিয়ে নেই শব্দ দূষণের এই প্রতিযোগিতায়। মসজিদ, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, কোর্ট ইত্যাদি স্থানগুলোতে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ থাকলেও সেসব স্থানে তারা হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে চলেছেন। উচ্চ আদালতে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার অনেক আগে নিষিদ্ধ হলেও তা মানছেন না যানবাহনের মালিক ও চালকরা। নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সদর্পে বাজিয়ে চলেছেন হাইড্রোলিক হর্ন।
সড়কে ট্রাফিক সার্জেন্ট ও পুলিশ থাকলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বেশিরভাগ বাসেই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার হচ্ছে এখনও। ট্রাকের তো কোনো কথাই নেই। তারা একাধিক হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে দেদারসে রাস্তায় চলাচল করছে। এছাড়া মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক এই শব্দ দূষণ থেকে পিছিয়ে নেই। কারণে-অকারণে তারা হর্ন বাজিয়ে চলেছেন।
মহানগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকা দিয়ে ভদ্রার দিকে যাচ্ছিলেন পথচারী সাইফুল ইসলাম। হাইড্রোলিক হর্নের শব্দে এই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় আতঙ্কে থাকেন বলে জানান তিনি।
সাইফুল ইসলাম বলেন, একে তো শহরের মধ্যে বাসস্ট্যান্ড এর ওপর মাত্রারিক্ত শব্দ দূষণ। দুইয়ে মিলে নাগরিক জীবন বিষিয়ে উঠছে। শহরের অদূরে বাস টার্মিনাল করা হলেও সেখানে বাস রাখা হয় না। সেখান থেকে সব বাস চলাচলও করে না। ফলে শহরের মধ্যে দিয়ে বাস-ট্রাকগুলো দিন-রাত দাপিয়ে বেড়ায়। তাদের হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের কারণে সাধারণ মানুষ শ্রবণশক্তি হারাচ্ছেন।
শব্দ দূষণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, নীরব এলাকা অর্থাৎ হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত আছে এমন এলাকায় দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবেলের চেয়ে বেশি শব্দ করা যাবে না। আবাসিক এলাকার ক্ষেত্রে এই মাত্রা ৫৫ ও ৪৫ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবেল। কিন্তু বর্তমানে এর কয়েকগুণ বেশি মাত্রার শব্দদূষণ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রা অনুযায়ী সাধারণভাবে মানুষ ৪০ থেকে ৪৫ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ ভালো শুনতে পায়। এর চেয়ে বেশি মাত্রার শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তিসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর স্থানীয়ভাবে হাইড্রোলিক হর্নের উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালের আশপাশে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এরপরও হাইড্রোলিক হর্নের উৎপাদন বা ব্যবহার বন্ধ হয়নি।
এদিকে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হাইড্রোলিক হর্ন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান ও গলা (ইএনটি) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সুব্রত কুমার ঘোষ। তিনি বলেন, হাইড্রোলিক হর্নের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি লোপ পাওয়া, হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া, স্নায়ুতে বিরূপ প্রভাব পড়া ও স্থায়ী বধির হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আর মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ শব্দের মধ্যে শিশুরা বড় হতে থাকলে তাদের মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এ ব্যাপারে সবাইকে অনেক বেশি সতর্ক থাকা জরুরি বলে মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
তবে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধ ও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, রাজশাহী মহানগর ট্রাফিক পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম।
ইফতে খায়ের আলম বলেন- হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে এরইমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু যানবাহন থেকে হর্ন খুলে ফেলা হয়েছে। অনেক যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মসজিদ, আদালতসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পাশে হর্ন বাজানো নিষেধ এমন ট্রাফিক সাইনও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যানবাহন মালিক ও চালকদের এ ব্যাপারে সচেতন করতে বিভিন্ন সময় লিফলেট বিতরণ ও সভা করা হচ্ছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৮
এসএস/আরআর