প্রযুক্তির কল্যাণে দেশে বসে আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার ঘটনা এখন স্বাভাবিক। তবে সেখানেও একটি ‘স্মার্ট’ প্রতারক চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গত ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কলাবাগান, ধানমন্ডি ও পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই সংঘবদ্ধ চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ। গ্রেফতাররা হলেন, জাহাঙ্গির কামাল চৌধুরী, রাজীব কুমার ভৌমিক ও সজিব কুমার ভৌমিক। তারা সবাই নোয়াখালীর বাসিন্দা।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে সিআইডি জানায়, ‘ফোরেক্স ট্রেডিং’-এর মাধ্যমে প্রতারণা করছিল এ চক্রটি। তারা স্মার্ট, উচ্চ শিক্ষিত, স্বচ্ছ্বল এবং বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে খুব ভালো জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিকে টার্গেট করে ওই ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করে। তাদের শিক্ষিত, স্মার্ট এবং টেকনোলোজিক্যালি সাউন্ড আচরনে বোঝার উপায় নেই যে আসলে তারা প্রতারক।
এরপর ভদ্রবেশি প্রতারক ওই ব্যক্তিকে একটি নতুন ব্যবসার সন্ধান দেন, যার মাধ্যমে ঘরে বসে অনলাইনে অল্প কিছু টাকা ইনভেস্ট করে বেশ ভালো উপার্জন করা সম্ভব। এরপর কথা মতো অনলাইন ঘাটাঘাটি করে ওই ব্যক্তিটি দেখেন ট্রেডস্টেশন.কম (www.tradestation.com) বা এ ধরনের একটা সাইটের সাহায্যে বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ আন্তর্জাতিক শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছেন, বেশ লাভবানও হচ্ছেন। বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ শেষে লাভবান হওয়ার আশায় ওই ভদ্রলোক আন্তর্জাতিক শেয়ার সাইটে বিনিয়োগ করতে রাজি হন এবং ভদ্রবেশি ওই প্রতারককে বিষয়টি জানান।
প্রথমে ওই সাইটে একটা ইউজার আইডি খুললে কিছু বোনাস ভার্চুয়াল কারেন্সি জমা হয় যা বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই আইডিতে আরও কিছু ভার্চুয়াল কারেন্সি যুক্ত করার কথা বলে বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে কিছু নগদ টাকা নেওয়া হয়।
কিন্তু এরমধ্যেই একটা সুক্ষ্ম কারচুপি ঘটে যায়। ওই বিনিয়োগকারী দেখেন পূর্বের ওই ওয়েব সাইটের .info বা .com এর স্থলে .global/.online/.asia/.biz/.org ইত্যাদির দেখাচ্ছে। এর কারণ জানতে চাইলে চক্রটি কৌশলে জানায়, এটা একই সাইটের একটা ‘ব্রোকার হাউজ ভার্সন’ যেখানে বিশেষ বিশেষ অনেক সুবিধা রয়েছে। আর এই ব্রোকার হাউজটা শুধু বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ডিল করে। বাংলাদেশ থেকে যারা বিনিয়োগ করে সবাই এখানেই করে।
এরপর বিনিয়োগকারীর কাছে একটার পর একটা বিভিন্ন লোভনীয় ও লাভজনক ব্যবসায়িক প্রস্তাব আসতে থাকে। তিনি দেখেন, এই ব্যবসায় একটু সময় দিলে বা বিভিন্ন পর্বে অংশ নিলে একদিনেই ২৫০-৩০০ ডলার আয় করা যায়।
ফাঁদে পড়ে বিনিয়োগকারীও নতুন নতুন আইডি খুলতে থাকেন। জীবনের সব জমানো অর্থও হয়তো এখানে কাজে লাগান। এরপর বিনিয়োগকারী যখন দেখেন তার একাউন্টে ৮০-৯০ হাজার বা তারও বেশি ডলার জমা হয়ে গেছে, তখন টাকা তোলার কথা ভাবতেই তাকে নতুন নিয়মের কথা বলা হয়। তারা বলে, আইডি’র একটা নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার আগে ভার্চুয়াল কারেন্সি ক্যাশ করা যাবে না। আবার যখন তোলা যাবে তখন একদিনে সর্বোচ্চ ৫০ ডলারের বেশি ভাঙানো যাবে না।
এর কিছুদিন পর হয়তো বিনিয়োগকারী দেখেন সাইটটিতে ঢুকতে চাইলে বারবার ৪০৪ বা ৫০৬ এরর মেসেজ আসছে। উপায় না পেয়ে ‘সেই ভাইকে’ ফোন দিলে তা আর রিসিভ হবে না। ততোদিন যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। ভার্চুয়াল কারেন্সিতে রূপান্তরের কথা বলে বিনিয়োগের সব অর্থ ‘সেই ভাই’ নিয়ে পালিয়েছে।
এভাবে আবার নতুন জেলায় নতুন কোনো উচ্চ শিক্ষিত স্বচ্ছল লোককে টার্গেট করে প্রতারণা অব্যাহত রাখে চক্রটি।
সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে এই প্রতারক চক্রটি বাংলাদেশের নোয়াখালী, কুমিল্লা, সাভার, গাইবান্ধা ও দিনাজপুরের প্রায় ৫ হাজার ৪০০ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ চক্রের দ্বারা প্রতারিত হয়ে একজন ভিকটিম গত ৯ জুলাই রাজধানীর কদমতলি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এর ভিত্তিতে চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৮
পিএম/এনএইচটি