ঢাকা, বুধবার, ৮ মাঘ ১৪৩১, ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

কালাবদর ওলট-পালট করে দিচ্ছে শ্রীপুরবাসীর জীবন

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৮
কালাবদর ওলট-পালট করে দিচ্ছে শ্রীপুরবাসীর জীবন ভাঙনের শিকার শ্রীপুর গ্রাম। ছবি: বাংলানিউজ

বরিশাল: ষাটোর্ধ গণি চৌকিদার, সারজীবন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর বাজার পাহারার কাজ করে গেছেন। পাহারা দিয়ে চুরি-ডাকাতি ঠেকিয়েছেন ঠিকই কিন্তু কালাবদর নদীর ভয়াল গ্রাসে রক্ষা করতে পারেননি বাজারের মূল অবস্থান। একইসঙ্গে হারিয়েছেন নিজের বাড়িঘর ও ফসলি জমি। সহায়সম্বল হারিয়ে স্ত্রী সন্তানহীন গণি চৌকিদার এখন স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের দেওয়া জমিতে কোনোভাবে একটি টঙঘর উঠিয়ে মাথা গোজার ঠাঁই করে নিয়েছেন।

তবে সেই ইউপি সদস্য আব্দুর ছালাম হাওলাদারেরও পথে বসার উপক্রম হয়েছে। কারণ বার দেওয়া কানি কানি সম্পত্তি নদীতে গ্রাস করে নিচ্ছে।

যে সম্পত্তির ওপর নিজেদের পুকুর বাধানো বাড়ি, শ্রীপুর বাজারের কয়েকশ’ দোকন, ফসলি জমি ছিল, সেই জমি আজ হারিয়ে গেছে কালবাদর নদীর গর্ভে। এখন শুধু বসবাসের ঘরটুকু টিকে থাকলেও রাত জেগে পাহারা দিতে হয়, কারণ কখন যে কালাবদর গ্রাস করে নেবে সেটুকু। ভাঙনের শিকার শ্রীপুর বাজার।  ছবি: বাংলানিউজশুধু এরাই নয়, গত তিন বছরের ভাঙনে শ্রীপুরের হোসেন খান, মমতাজ বেগম, বারেক গাইনসহ বেশ কয়েকজন পথের ভিখারি হয়ে সাহায্যের হাত পেতে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

নাম-যশ আর জৌলুস হারিয়ে বিলীন হয়েছে শ্রীপুরের নলী বাড়ি, খাঁ বাড়ি, হাজি বাড়ি, হজরত আলী খাঁ বাড়ি, ইয়াসিন ঘরামি ও হাসেম সিকদারের বাড়ির ৩০ একরের বেশি সম্পত্তি।

স্থানীয়দের মতে, গত তিন বছর ধরে ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করেছে কালাবদর নদী। আর তাতে এসব বাড়ি কিংবা ফসলি জমিই শুধু নয় বিলীন হয়ে গেছে শ্রীপুরের হিন্দুদের একটি গ্রাম, শ্রীপুর বাজার ঘিরে নির্মিত দু'টি মসজিদ, একটি মাদ্রাসা, বাহেরচর শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নবনির্মিত একটি ও পুরাতন একটি দ্বিতল ভবন, বাহেরচর শ্রীপুর কমিউনিটি সেন্টার, ভূমি অফিসসহ বহু স্থাপনা।

বাজারের ব্যবসায়ী মালেক খাঁন বাংলানিউজকে বলেন, কালাবদর নদী একসময় ভয়ঙ্কর ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের আগে ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে কালাবদর নদীর ভয়াল গ্রাসে কখনো পড়েনি শ্রীপুর। কিন্তু গত তিন বছর ধরে আকস্মিক ও অব্যাহত নদী ভাঙনে শ্রীপুর বাজার মূল জায়গা থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে সরে এসেছে। বাজারের সাড়ে ৩শ' ব্যবসায়ীকে ৩ বছরে ৭ বারেরও বেশি সময় ধরে দোকানঘর সরাতে হয়েছে। বর্তমানেও পুরো গ্রামজুড়ে চলছে নতুন ঘরের নির্মাণযজ্ঞ। আর প্রতিবার একটি দোকান ঘর সরাতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার গুনছেন ব্যবসায়ীরা। সে হিসেবে শুধু বাজার কেন্দ্রীক বছরে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি সাধন হচ্ছে। অন্যের জমিতে টং ঘর উঠিয়ে মাথা গোজার ঠাঁই কিরে নিয়েছেন গণি।  ছবি: বাংলানিউজনদী ভাঙনরোধে দাবি উঠলেও তিনবছরে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি কেউ। তাই গত বছর বাহেরচর শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নবনির্মিত দোতলা ভবনটি আর এবছরে পুরাতন ভবনটি নদীগর্ভে চোখের সামনে বিলীন হতে দেখেছেন শ্রীপুরবাসী। এমনটাই জানিয়েছেন শ্রীপুরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নোমান মোল্লা।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শ্রীপুরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের অধিকাংশ এলাকা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন, সংসদ সদস্যসহ সবাইকে জানানো হয়েছে তবে কার্যত পদক্ষেপ নেই।

এদিকে বিদ্যালয়ের দু'টি ভবনই হারিয়ে দিশেহারা বাহেরচর শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে ৩শ' শিক্ষার্থীরা। স্বাভাবিক পাঠদান কার্যক্রমে বিঘ্নতা ঘটা আর চোখের সামনে স্কুলভবন নদীগর্ভে বিলীন হতে দেখে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী নুসরাত জাহান চিঠিও লিখেছেন শিক্ষামন্ত্রী বরাবরে। দ্বিধাদন্ধে বাবা চিঠিটি ডাকযোগে পাঠাতে না পারলেও সেটির ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছেন।

মন্ত্রীর হাতে না পৌঁছালেও নুসরাতের চিঠি গ্রামের মানুষকে জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা, তাই হয়তো টিনশেড ঘর নির্মাণের কাজ জোড়েসোরে চালিয়ে যাচ্ছেন বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা। আর এ মুহুর্তে শিক্ষকরা তাদের বাড়িতেই চালিয়ে যাচ্ছেন পাঠদান কার্যক্রম।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাহামুদ হাসান জানান, নদী থেকে ২ কিলোমিটার দূরে ছিল বাহেরচর শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন। আর সেই নদীর কারণে প্রায় তিনমাস ধরে ভবন নেই। তাই হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে শিক্ষকরা পিএসসি পরীক্ষার্থীদের তাদের বাড়িতে ক্লাস করাচ্ছেন। আর বিভিন্ন পরীক্ষা নিয়েছেন শ্রীপুর মহিষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চরবগি এ রব দাখিল মাদ্রাসায়।

এদিকে ম্যানেজিং কমিটি দৌড়ঝাপ দিয়ে প্রাথমিকের বিভাগীয় উপ-পরিচালকের সহায়তায় ৩ লাখ টাকার একটি অনুদান নিয়েছেন। যা দিয়ে বিদ্যালয়ের জন্য টিনশেডের একটি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। খালের খাস জমিতে ঘর নির্মাণের কাজ অল্প কিছুদিনের মধ্যে শেষ হলে আবার ক্লাসের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হবে।

তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমে যাবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এই নদী ভাঙনের কারণে ঐতিহ্যবাহী বাহেরচর শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হারিয়েছে তার জৌলুস। বিদ্যালয়ের সবকিছু সঠিকভাবে চালাতে হলে আরো অর্থের প্রয়োজন, উপজেলা প্রশাসনকে লিখিত দিয়েছি, জানিয়েছি নদী ভাঙনের কথা কিন্তু কোনো সহায়তা এখনো পাইনি। বরং এমপিকে বলার পর তিনি ১০ বান টিন ও নগদ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি খোঁজও রাখছেন।

তিনি বলেন, বিদ্যালয় ও নদী ভাঙনরোধে গ্রামের মানুষ যে যার মতো বলে যাচ্ছেন। মানববন্ধন করেছেন, স্মারকলিপি দিয়েছেন, সাংবাদিকরা লিখছেন কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। তিনবছরের অব্যাহত ভাঙনে দুই কিলোমিটারের বেশি গ্রামের ভেতরে চলে এসেছে নদী। কিন্তু নদী বড় হয়নি, ওপারে চর পড়ে যাচ্ছে আর এপার ভাঙছে। নদীর ভাঙনে পথের ভিখারী হয়ে দেশে ছেড়েছেন অনেকে, সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে ধনী হয়ে যাচ্ছে গরিব। যেন সবকিছু ওল্ট-পাল্ট হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৮
এমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।