ঢাকা, মঙ্গলবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

শালিশের ‘ফতোয়া’য় একঘরে তাহেরা

অপু দত্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮
শালিশের ‘ফতোয়া’য় একঘরে তাহেরা তাহেরা বেগম ও তার পরিবারের সদস্যরা। ছবি: বাংলানিউজ

খাগড়াছড়ি: গ্রাম্য শালিশের ‘ফতোয়া’য় একঘরে বৃদ্ধা তাহেরা বেগম (৬৫)। শালিশ বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাহেরা বেগম গ্রামের কারও সঙ্গে মিশতে পারবেন না। গ্রামের লোকজন তার বাড়িতে যাতায়াত করতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, তিনি স্থানীয় কোনো দোকান থেকে ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারবেন না। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তবে সেই দোকান বন্ধ করে দেওয়া হবে। এমনটি ঘটনা ঘটেছে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার খেদাছড়ার ঢাকাইয়া পাড়া এলাকায়।

তবে, গ্রাম্য শালিশের এ বিচারকে স্থানীয় একটি পক্ষ স্বাভাবিকভাবে দেখছেন। তাদের মতে, তাহেরা বেগমের আচরণগত সমস্যা আছে।

তাই এমন বিচার তাকে উচিৎ শিক্ষা দেবে। অপর পক্ষ বলছেন আধুনিক সমাজে মধ্যযুগীয় আচরণ অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই না।

জানা যায়, গত ১৪ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) প্রতিবেশী জামিলা বেগম এলাকার সমাজপতিদের কাছে অভিযোগ করেন তাহেরা বেগমের ছেলে জাকির হোসেন অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। এ নিয়ে জমিলা বেগমকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন জাকির। পরে শালিশ  বৈঠকে এ বিষয়ে তাহেরা বেগম প্রতিবাদ করলে সমাজপতিতের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে এলাকার সমাজ কমিটির সভাপতি আমান উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক মো. নুরন্নবী, শফি মিলে জাকির হোসেনকে কান ধরে ওঠবস করান ও তাহেরা বেগমের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ বা আদান-প্রদান করতে এলাকাবাসীকে নিষেধ করেন।

এছাড়া তাহেরা বেগমের কাছে স্থানীয় দোকানদাররা ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। এরপর থেকে কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলছেন না এবং দোকারদাররা তাদের কাছে কোনো কিছু বিক্রি করছেন না।

তাহেরা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আমার পাঁচ বছরের নাতি আল-আমিনকে প্রতিবেশী জমিলা বেগমের সাত বছর বয়সী নাতি শাহাদাত প্রায় মারধর করতো। শেষবার আমার নাতির গলা চেপে ধরে পাশের নদীতে ফেলে দেয় শাহাদাত। এ নিয়ে আমি অনেকবার জমিলা বেগমের কাছে অভিযোগ করেছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। উল্টো তিনি আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। কয়েকবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে। মূলত সেই ক্ষোভ থেকে আমাকে সমাজপতিদের দিয়ে একঘরে করেছেন জমিলা বেগম। এখন আমি কারও সঙ্গে মিশতে পারছি না। এমনটি অসুস্থ হওয়ার পরও ওষুধ পর্যন্ত কিনতে পারছি না।

স্থানীয় ফার্মেসির মালিক হাফেজ মো. ওমর ফারুক ও চায়ের দোকানি তোবারক হোসেন বলেন, বিচারের পর সমাজপতি আমান উল্লাহের ভাতিজা ফজলু দোকানে এসে তাহেরা বেগমের কাছে কোনো কিছু বিক্রি না করা, কথা না বলা এবং বাড়িতে যেতে নিষেধ করে গেছেন। তাই সমাজপতিদের রায় অমান্য করারতো কোনো সুযোগ নেই।

মাটিরাঙ্গার বেলছড়ি ইউনিয়নের ৫নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) হাসমত আলী বলেন, আমি বিচারের শেষ দিকে উপস্থিত ছিলাম। বিস্তারিত জানি না। তবে তাহেরা বেগমের সঙ্গে কেউ যেনো কথা না বলে সেটা বলতে শুনেছি। অনেকটা একঘরে করে দেওয়ার মতো রায় দেয়া হয়েছে।

এদিকে একঘরে করার বিষয়টি অস্বীকার করে সমাজ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. নুরন্নবী বলেন, ‘তাহেরা বেগম মানুষ হিসেবে ভালো না। এলাকার লোকজনের সঙ্গে ঝগড়া করেন। তাই, ভয় দেখাতে আমরা বলেছি কেউ যেনো তার সঙ্গে না মিশে।

সভাপতি আমান উল্লাহ এলাকায় না থাকায় ও মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
 
মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, আধুনিক সমাজে এমন রায় কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া যায় না। এটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। তাহেরা বেগমের কোনো দোষ থাকলে আইনের আশ্রয় নেওয়া যেতো। এভাবে সমাজচ্যুত করার সুযোগ নেই। পুলিশকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৮
এডি/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।