ঢাকা, সোমবার, ১২ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ভেড়া পালন করে সাজানো জীবন ফরিদার

সাগর ফরাজী, সাভার করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৯
ভেড়া পালন করে সাজানো জীবন ফরিদার ভেড়া পরিচর্যায় ব্যস্ত ফরিদা খাতুন। ছবি: বাংলানিউজ

সাভার (ঢাকা): ফরিদা খাতুন যখন দুই মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা, তখন তাকে ছেড়ে চলে যান স্বামী। বিয়ে করেন অন্য এক নারীকে। তখন ফরিদাকে নিয়ে যান মা-বাবা। মা-বাবার ঘরেই ফরিদার কোলজুড়ে আসে এক সন্তান। এরপর মা-বাবা ফরিদাকে আবারও নতুন করে ‘জীবন সাজানো’র জন্য বিয়ে করার কথা বলেন। কিন্তু সন্তানের ভবিষ্যৎ সাজাতে ফরিদা এ বিষয়ে কথা বলতে বারণ করে দেন মা-বাবাকে। তারপর ফরিদা তার মতো করেই জীবন সাজান।

৮০ টাকায় কেনা একটি ভেড়া লালন-পালন শুরু করে ফরিদা এখন একটি ভেড়ার খামারের মালিক। করেছেন একটি গোলাপের বাগান।

তার সন্তান বাবুল মিয়াকে বিয়ে করিয়েছেন ঘটা করে। বাবুল করে দিয়েছেন একটি দোকান। স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর যে ফরিদার ‘ভাগ্য’ নিয়ে মা-বাবা দুশ্চিন্তায় ছিলেন, সেই ৫১ বছর বয়সী সেই ফরিদার সাফল্য এখন অনেকের অনুপ্রেরণার গল্প।

সাভারের বিরুলিয়া এলাকার ফরিদা খাতুনের এ গল্পের শুরু ১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তার সঙ্গেই কথা হচ্ছিলো জীবন-সংগ্রাম নিয়ে।  

ফরিদা জানান, তার ভাই আবুল হোসেন ১৯৮৫ সালে ৮০ টাকা দিয়ে একটি ভেড়া কিনে দিয়েছিলেন। তখন ফরিদার ছেলে বাবুল হোসেনের বয়স মাত্র দুই বছর। সেই একটি ভেড়া থেকে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে হতে এখন সাভারের কুমারখোদা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ফরিদা খাতুন বিশাল এক ভেড়ার খামার। ৩৪ বছর ধরে ভেড়া লালন-পালন করে তিনি এখন অনেক উদ্যোক্তার কাছে অনুকরণীয় উদাহরণ।

মাঠে ভেড়া চরাতে যাচ্ছেন ফরিদা খাতুন।  ছবি: বাংলানিউজফরিদা খাতুনের ছেলে বাবুল মিয়া (৩৬) বাংলানিউজকে বলেন, ‘মা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তার কারণেই আমরা আজ ভালোভাবে চলতে পারছি। আমার ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ তিনিই চালাচ্ছেন। আমাকে ও আমার ছেলে-মেয়েদের বড় করতে তার সর্বোচ্চ বিলিয়ে দিয়েছেন। প্রতিদিন সকালে মা ভেড়াদের মাঠে চরাতে নিয়ে যান। তিনি তার ভেড়াদের সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। যদি কোনো ভেড়া কোনো কারণে মারা যায়, তাহলে আমাদের ঘরে যেন শোকের ছায়া নেমে আসে। ’

ফরিদা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, ‘পেটে দুই মাসের সন্তান রেখে স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে যান। আমার তখন মাত্র ১৭ বছর বয়স। স্বামী আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর আমি নিজেই কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। এসময় আমার ভাই আমাকে একটি ভেড়ার বাচ্চা এনে দেন। আর এ ভেড়ার বাচ্চাকে দিয়েই শুরু হলো আমার জীবনের সংসার, ভেড়ার সংসার। ’

ফরিদার খামারে এখন মোট ভেড়ার সংখ্যা ৪০টি। তবে বছরখানেক আগেও ছিলো ৮৩টি। জায়গা স্বল্পতা ও নিজের বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে ফরিদা বিভিন্ন সময় ভেড়া বেচে কমিয়ে ফেলেছেন।

সংগ্রামী নারী ফরিদা খাতুনপ্রতিবছর কতোগুলো ভেড়া বেচেন এবং কোথায় বেচেন? এমন প্রশ্নে ফরিদা খাতুন বলেন, ‘৩৫ বছর হইলো ভেড়া লালন-পালন করছি। ৩-৪ বছর আগেও বছরে ৩৫-৪০টির মতো ভেড়া বেচতাম। আগে দাম ছিল কম, এখন দাম বাড়ছে। বাড়ির পাশের বাজারে ভেড়া নিয়ে গেলে প্রতি ভেড়া ৭-৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। বিভিন্ন সময় সংসারে টাকার দরকার হলে ভেড়া বেচার টাকা দিয়ে প্রয়োজন মেটে। বছরে দুইবার ভেড়া বাচ্চা দেয়, প্রতিবার ২-৩টি করে বাচ্চা দেয়। বয়স হয়েছে, এতোগুলো ভেড়া পালতে কষ্ট হয়ে যায়। তাই ভেড়া বেচে কমিয়ে ফেলেছি। ’

হাসিমাখা মুখে ফরিদা বেগম বলেন, ‘নাতি-নাতনিদের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছি আমি। এ ভেড়া লালন-পালন করে একটি গোলাপের বাগান করেছি। ফুলের বাগান করার জন্য ছেলেকে জমির লিজ নিয়ে দিয়েছি। গত বছর ভেড়া বেচে ছেলেকে একটি দোকানও দিয়ে দিয়েছি। আমি এখন ভেড়া ও আমার পরিবার নিয়ে ভালোই আছি। ’
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৯
জিপি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।