তদন্ত শেষে এমন তথ্যই উল্লেখ করা হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) তদন্ত প্রতিবেদনে। আইইবির ৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি অগ্নিকাণ্ডস্থল পরিদর্শন ও তদন্তের পর গত শনিবার (২ মার্চ) প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রতিবেদনটি দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের স্থান নির্দিষ্ট হলেও উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে ফরেনসিক তদন্ত প্রয়োজন। কারণ চাক্ষুষ দর্শনে কোনো আলামতের উপস্থিতি নেই সেখানে। তবে এটা বলা যায়, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে কোনো গ্যাসের সিলিন্ডারে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়নি।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি দিনগত রাত সাড়ে ১০টার দিকে চকবাজারের চুড়িহাট্টা জামে মসজিদ সংলগ্ন ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এই অগ্নিকাণ্ডে পাঁচটি ভবন একেবারে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এতে তখন প্রাণহানি হয় ৬৭ জনের। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনাটি তদন্তে ২৩ ফেব্রুয়ারি আইইবির ৬ সদস্যের ওই কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটির সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় ছিল প্রসাধনী সামগ্রী এবং বডি স্প্রের প্রস্তুত কারখানা ও গুদাম। আগুনের সূত্রপাত সেখান থেকেই। প্রাপ্ত সিসিটিভি ফুটেজ থেকে সূত্রপাতের স্থান সম্পর্কিত বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিপুল পরিমাণ অতি দাহ্য পদার্থ থাকায় যে কোনো উপায়ে সৃষ্ট আগুনে বিস্ফোরণ ঘটলে দোতলার বাইরের অংশের দেয়াল ভেঙে রাস্তায় পড়ে এবং ভেতরের অংশের দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়ে। ভেতরে অক্সিজেনের ঘনত্ব কম থাকায় পাশের মসজিদের দিকে আগুন ধাবিত না হয়ে পাশের রাস্তার দিকে ধাবিত হয়। তাই মসজিদটি অক্ষত অবস্থায় থাকলেও দাহ্য পদার্থের উপস্থিতিতে বিস্ফোরণে আগুন পাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ওয়াহেদ ম্যানশনের একতলার সিঁড়িটিও অক্ষত রয়েছে।
আগুনের সূত্রপাতের কারণ সঠিকভাবে নির্ণয় করতে ফরেনসিক তদন্ত প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাশে বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো ট্রান্সফরমার ছিল না, কিছুটা দূরেই ট্রান্সফরমার ও বৈদ্যুতিক লাইন অক্ষত দেখা গেছে। ওয়াহেদ ম্যানশনের সুইচবোর্ড থেকেও শর্ট সার্কিটের কোনো আলামত মেলেনি। ভবনটির নিচে প্লাস্টিকের সামগ্রী বহনকারী যে ট্রাকটি ছিল, সেটি ডিজেলচালিত। তবে তার পাশে থাকা মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে, আগুন ছড়ায় এই সিলিন্ডার বিস্ফোরণেও। আগুন সৃষ্টির কারণ হতে পারে সুইচ অন করার সময় স্ফুলিঙ্গ বা দাহ্য পদার্থ মজুত সংলগ্ন এলাকায় কর্মরত ব্যক্তিদের অসাবধানতাবশত জ্বালানো আগুন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট আইইবির প্রকৌশলীদের একটি সূত্র বলছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় বাদামের তেল, রেঢ়ীর তেল, জলপাইয়ের তেল, এয়ার ফ্রেশনার ও সুগন্ধী ছিল। এই এয়ার ফ্রেশনার ও সুগন্ধির বোতলও রিফিল করা হতো সেখানে। এসব সামগ্রী উদ্বায়ী ও অতিদাহ্য পদার্থ। এসবের অন্যতম উপাদান ইথানলের ফ্লাশ পয়েন্ট ১৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সুপারিশ
ওয়াহিদ ম্যানশনের এই ট্র্যাজেডির পর এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য যে কোনো উপায়ে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গুদাম সরানো, আইনের যথাযথ প্রয়োগের পরামর্শসহ ৬টি সুপারিশমালা দিয়েছে আইইবির তদন্ত দল। সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে সরকারের বিভিন্ন সেবা সংস্থার (গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য) কার্যক্রম সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসা, প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগসহ সংস্কার এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আইইবির তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব প্রকৌশলী কাজী খায়রুল বাশার বাংলানিউজকে জানান, তদন্তে আমাদের বিশেষজ্ঞরা কাজ করেছেন। তাদের মতে, সেখানে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা নিচে কোনো সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়নি। সূত্রপাত দোতলা থেকেই। হতে পারে ওই এয়ার ফ্রেশনার রিফিলের জায়গায় কেউ সিগারেট ধরাতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে। কারণ সেখানে দাহ্য পদার্থের ঘনত্ব বাতাসে অনেক বেশিই ছিল বা সেটাই স্বাভাবিক ছিল। আর আগুন রাস্তার এক পাশ থেকে অন্য পাশে বা এক ভবন থেকে অন্য ভবনে গেছে। এক্ষেত্রে বলা যায়- যেখানেই দাহ্য পদার্থ পেয়েছে সেদিকেই আগুন গেছে। অন্যান্য ভবনে প্লাস্টিক মজুদ করার জায়গা বা আরও কেমিক্যালের গুদামের কারণে আগুনটা প্রতিনিয়ত বিস্ফোরণের মাধ্যমে বড় হয়েছে। যে কারণে মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়েছে।
তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা জমা দিয়েছি। এ পরিস্থিতির যেন আর সৃষ্টি না হয়, সেজন্য পরবর্তী করণীয়গুলোও উল্লেখ করেছি প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৯
এমএএম/এইচএ/