শৈশবের স্মৃতিচারণে কথাগুলো বলেই একটু মৃদু হাসলেন অরুন্ধতী রায়। তারপর আবার বললেন, যতদূর মনে পড়ে আমার লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাক্য ছিল- ‘আই হেট মিস মিটেন’।
মঙ্গলবার (০৫ মার্চ) রাতে ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারের ইএমকে কনফারেন্স কক্ষে কথা বললেন বিশ্বখ্যাত ভারতীয় লেখিকা ও মানবাধিকার স্বক্রিয়তাবাদী অরুন্ধতী রায়।
এসময় অতি স্পষ্ট ভাষায় তার লেখালেখি, বিশ্বের চলমান রাজনীতি, পানিবন্টন, সংস্কৃতিসহ বিবিধ বিষয়ে কথা বলেন তিনি। তবে সবার সুযোগ হয়নি এতে অংশ নেওয়ার। শুধুমাত্র নিবন্ধনের মাধ্যমে সৌভাগ্যবান কিছু শ্রোতা উপভোগ করেছেন এ আয়োজন। আলাপচারিতার পর্বটি সঞ্চালনা করেন ছবিমেলার উৎসব পরিচালক শহীদুল আলম।
দ্য গড অব স্মল থিংস উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করা অরুন্ধতী রায় বইটির বিষয়ে বলেন, যদি কুড়িজন পাঠকও এটি পড়তো তাহলেও আমার উপন্যাসটি একইরকম থাকতো। দীর্ঘ একটা সময় নিয়ে আমি বই লিখেছি। প্রথম লেখা বই এতটা আলোচিত হওয়ায় অনেকেই বলেছে, এটি নিয়ে আমার উচ্চাশা ছিল। তবে নিজের ভেতরে একটা উচ্চাকাঙ্খা ছিল যে বইটি যেন বেশি মানুষ পড়ে।
অবশ্য হয়েছেও তাই। এখন পর্যন্ত 'দ্য গড অব স্মল থিংস' বইটি ৪২টি ভাষায় ৬ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।
আলাপচারিতায় অরুন্ধতী রায় কথা বলেন বাংলাদেশে আসা নিয়ে। ছবিমেলায় কেন এসেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে অরুন্ধতী বলেন, তোমার জন্য এসেছি, তোমাদের জন্য এসেছি। এখানে নতুন প্রজন্মের একঝাঁক মানুষকে দেখতে পাচ্ছি; যারা আলোকচিত্র নিয়ে কাজ করছে। তাদের কাজগুলো দেখতে খুব ভালো লাগছে আমার। আর এ টানেই আমি ছুটে এসেছি।
ভারতের চলচ্চিত্র, সাহিত্য, চিত্রকলাসহ শিল্প-সাহিত্যেও নানা অঙ্গনের মানুষদের নিয়ে আর্টিস্ট ইউনাইট নামের একটি প্ল্যাটফরম নিয়ে কাজ করছেন অরুন্ধতী। এ কার্যক্রমের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৫-১৬ সময়কালে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষরা নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছিল। কিন্তু এ মানুষগুলো ছিল একেবারেই নিরপরাধ। রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার কাছে এ মানুষগুলো একেবারেই অসহায় ছিল। এ কারণেই সেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
লেখক হিসেবে যখন তিনি রীতিমতো তারকায় পরিণত হয়েছেন তখন সে অবস্থান তিনি ঝুঁকলেন রাজনীতিবিষয়ক লেখালেখিতে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বুকার জেতার পর ভারতের প্রতিটি ম্যাগাজিনে আমার ছবি ছাপা হয়েছে। একটা সময়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলো। তার পরপরই একটি পারমাণবিক পরীক্ষার ঘটনা ঘটলো। সবাই খুব উচ্ছসিত। সবার ভেতরে জাতীয়তাবোধের বীজ আরো উসকে উঠলো। সে সময় আমি প্রথম লিখেছিলাম রাজনীতিনির্ভর প্রবন্ধ ‘দ্য অ্যান্ড অব ইমাজিনেশন’। আমার কাছে মনে হলো, আমরা নতুন এক ঔপনিবেশিক যুগে ধাবিত হচ্ছি। ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে আমাদের চিন্তার জগত।
বর্তমান সময়ের গণতন্ত্রের বিষয়ে লেখিকা বলেন, উপমহাদেশে আশি শতকের দিকে গণতন্ত্রের যে ধারাটি ছিল সেটি এখন শুধুই নির্বাচনকেন্দ্রিক। এ অঞ্চলের এখন গণতন্ত্র মানেই যেন নির্বাচন।
এসময় তিনি ‘লাইফ আফটার ডেমোক্রেসি’ নামের একটি লেখা থেকে পাঠ করেন। উন্নয়নের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বিশ বছর আগে যখন উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হতো তখন মানুষকে বোঝানো হতো, উন্নয়ন হলে মানুষ চাকরি পাবে, কর্মসংস্থান হবে, দারিদ্র্য দূর হবে। কিন্তু খোদ ভারতে লাখ লাখ মানুষ বেকার। উন্নয়ন মানেই বিনিয়োগের লভ্যাংশ সর্বোচ্চ পরিমাণ বাড়ানো। এ উন্নয়নের পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সামান্যসংখ্যক মানুষ লাভবান হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে না।
নদী ও পানির কোনো বাধায় তার বিশ্বাস নেই বলেও এসময় উল্লেখ করেন তিনি। অরুন্ধতী বলেন, পানি ও নদীর কোনো বাধায় আমি বিশ্বাস করি না। চাইনা কোনো প্রতিবন্ধকতা। তাই এগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ভারতের অনেক নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে হাজার মানুষের কয়েক শত জমি নষ্ট হয়েছে।
এছাড়া, বাঁধগুলো নির্মাণের ফলে অসংখ্য আদিবাসী ভূমিহীন হয়েছে। আর এজন্যই ভারতের আরো বেশি মানবিক হওয়া উচিত বলেও মনে করেন ম্যনবুকার জয়ী ভারতীয় খ্যাতিমান লেখিকা অরুন্ধতী রায়।
বাংলাদেশ সময়: ০০৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৯
এইচএমএস/এসএইচ