ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

বলাৎকারের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ‘ছেলেধরা’ নাটক

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৯
বলাৎকারের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ‘ছেলেধরা’ নাটক ডগ স্কোয়াড দিয়ে কাটা মাথার সন্ধান করা হচ্ছে। ইনসেটে আবির। ছবি: বাংলানিউজ

চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গায় মাদ্রাসাছাত্র আবির হুসাইনের (১১) মাথাবিহীন মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ের গুজবের সঙ্গে কোনো মিল নেই। প্রকৃত ঘটনা হলো বলাৎকারের পর তা ধামাচাপা দিতেই গলাকেটে হত্যা করে কেটে ফেলা মাথা গুম করা হয়েছে। 

মূলত বলাৎকারের ঘটনা ধামাচাপা দিতে ‘ছেলেধরা’ বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে ঘাতকরা। এমনটিই ধারণা করছে পুলিশ।

 

বুধবার (২৪ জুলাই) রাতে বাংলানিউজকে এসব তথ্য জানান চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান।

মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই মাঠে নেমেছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। দিনভর অভিযান ও তদন্ত চালিয়ে পুলিশ পেয়েছে চাঞ্চল্যকর আরও তথ্য।

এ ঘটনায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাদ্রাসার ৫ শিক্ষককে আটক করেছে। বুধবার সন্ধ্যায় তাদের আটক করা হয়। আটকের পর তাদের থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার কয়রাডাঙ্গা গ্রামে কয়েক বছর আগে স্থানীয় বিত্তশালীদের আর্থিক সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয় একটি মাদ্রাসা ও এতিমখানা। মাদ্রাসাটির নাম দেওয়া হয় নুরানী হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা। বর্তমানে মাদ্রাসাটিতে অধ্যায়নরত রয়েছে প্রায় ৭১ জন শিক্ষার্থী। চুয়াডাঙ্গা জেলা বাদেও আশপাশের জেলাগুলো থেকে অধ্যায়নরত আছে বেশ কিছু ছাত্র।

চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, মাদ্রাসাছাত্রের হত্যার নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। আমরা বেশ কিছু তথ্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি দাবি করেন, সাম্প্রতিক সময়ের গুজবের সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের কোনো সর্ম্পক নেই। সুকৌশলে হত্যার ঘটনাটি ভিন্নখাতে দিতেই নিহত ওই ছাত্রের মাথা কেটে গুম করা হয়েছে। পদ্মাসেতুর জন্য ওই ছাত্রের মাথা কেটে নিয়ে গেছে বলেও স্যোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচারণা চালানো হয়েছে।

নেপথ্যে কাজ করেছে চিহ্নিত একটি গোষ্ঠী। তাদের আমরা আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি আরও জানান, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে ওই ছাত্রের ওপর দীর্ঘদিন ধরে যৌন নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো। যৌন নির্যাতনের ঘটনাটি ধামাচাপা দিতেই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে ওই ছাত্রকে। ময়নাতদন্ত রির্পোটেও এ বিষয়টি উঠে এসেছে বলে তিনি নিশ্চিত করেন।

এ ঘটনার পর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল মাদ্রাসাটির ৫ শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। আটক শিক্ষকদের হাতের ছাপ সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছে ঢাকাতে।

মাদ্রাসাটির মুহতামিম মুফতি আবু হানিফ জানান, ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে আবির হুসাইন প্রায় এক বছর আগে এই মাদ্রাসাতে ভর্তি হয়। তার মা কমেলা খাতুন তাকে ভর্তি করান। বর্তমানে আবির হুসাইন মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশুনা করতো।

মুফতি আবু হানিফের মতে, মঙ্গলবার এশার নামাজের একটু আগে থেকে আবির হুসাইন নিখোঁজ হয়। স্থানীয়দের সহযোগিতায় গ্রামের বিভিন্ন স্থানে অনেক খোঁজাখুজি করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এরপর সকালে গ্রামবাসী মাদ্রাসার অদূরে একটি আম বাগানের ভেতরে আবিরের মাথাবিহীন মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে।

আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান মুন্সি জানান, স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর
পেয়ে সকাল ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কানাই লাল সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. কলিমুল্লাহসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পুলিশ নিহত ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠাতে গেলে উত্তেজিত হয়ে ওঠে গ্রামবাসী। তারা মাদ্রাসা ছাত্র আবিরের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান গ্রামবাসীদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করেন। পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে গ্রামবাসীকে শান্ত থাকারও অনুরোধ জানানো হয়। আশ্বাস দেওয়া হয় ঘাতককে চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার।

এদিকে, চুয়াডাঙ্গার কয়রাডাঙ্গা গ্রামে মাদ্রাসা ছাত্রের মাথাবিহীন মরদেহ উদ্ধারের পর গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মাদ্রাসা থেকে ছাত্রদের তাদের অভিভাবকরা নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে যান।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের এক চিকিৎসকের ময়নাতদন্তের বর্ণনা দিয়ে মো. কলিমুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, ওই ছাত্রের ওপর দীর্ঘদিন ধরে যৌন নির্যাতন চালানো হতো। নির্যাতনের ঘটনাটি ধামাচাপা দিতেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। একই সঙ্গে সুকৌশলে হত্যার ঘটনাটি ভিন্নখাতে দিতে নিহত ওই ছাত্রের মাথা কেটে গুম করা হয়েছে। পদ্মাসেতুর জন্য ওই ছাত্রের মাথা কেটে নিয়ে গেছে বলেও স্যোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচারণা চালানো হয়েছে। নেপথ্যে কাজ করেছে চিহ্নিত একটি গোষ্ঠী। সব বিষয়গুলো মাথায় রেখেই আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে মাদ্রাসার ৫ শিক্ষককে। তাদের কাছ থেকেও অনেক তথ্য মিলেছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. শামীম কবির জানান, প্রাথমিকভাবে মলদ্বারের ক্ষত ও আঘাতের চিহ্ন দেখে মনে হয়েছে তাকে বেশ কিছুদিন ধরে বলাৎকার করে আসা হচ্ছিলো। বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডিএনএ টেস্ট ও নিহতের শরীরের সোয়াব সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

অপরদিকে, বিকেলে র‌্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন র‌্যাবের সদর দপ্তর থেকে হেলিকপ্টারে করে ডগ স্কোয়াড নিয়ে একটি বিশেষ টিম চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছেছে। ৫ সদস্যর ওই টিমে ছিল দু’টি ডগ স্কোয়াড। টিমের সদস্যরা সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত ঘটনাস্থলসহ আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা অনুসন্ধান চালিয়েও নিহত মাদ্রাসা ছাত্রের কেটে ফেলা মাথা উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। তবে র‌্যাবের টিমটি তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রখেছে।

দলটির প্রধান ঝিনাইদহ র‌্যাব ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মাসুদ আলম বাংলানিউজকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে গুজবের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। মাদ্রাসাছাত্র আবির হুসাইনকে হত্যার পর অত্যন্ত কৌশলে সাম্প্রতিক গুজবে রুপ দিতে কাজ করেছে হত্যাকারীরা।  

বাংলাদেশ সময়: ০৫৫০ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৯
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।