ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

যেভাবে তৈরি লোভনীয় স্বাদের দই

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৯
যেভাবে তৈরি লোভনীয় স্বাদের দই

বগুড়া: সারিবদ্ধ চুলায় জ্বলছে আগুন। লেলিহান শিখায় গমগম করছে পুরো ঘর। পা ফেলতেই আগুনের তাপ যেন পোশাক ভেদ করে সরাসরি শরীরে এসে লাগছিল। প্রচণ্ড তাপে ঘরের ভেতর অপেক্ষা করাই ছিল অত্যন্ত কঠিন।

চুলায় চুলায় ছিল দুধ ভর্তি কড়াই। কড়াইয়ের চারপাশ দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা বেরুচ্ছিল।

কিন্তু কোনোভাবেই আগুনের মাত্রা কমানোর ভাবনা ছিল না। উল্টো কি করে তাপ বাড়ানো যায় তা নিয়েই ব্যস্ত দেখা গেছে কারিগরদের।
 
আগুনের গতি বাড়াতে প্রায়ই চুলায় লাকড়ি দেওয়া হচ্ছিল। সঙ্গে কড়াই ভর্তি দুধ বিরতিহীন নেড়ে চলছিলেন কারিগররা। টানা প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো জ্বাল দিতে হবে এই দুধ। কারণ দুধে থাকা পানি কোনোভাবেই দুধে থাকা চলবে না। তাহলে বোঝেন এবার দই তৈরির কারিগরদের অবস্থা কেমন।
 
বগুড়ার শেরপুর পৌরশহরের ঘোষপাড়ায় একটি দই তৈরির কারখানায় গিয়ে গুণে-মানে লোভনীয় স্বাদে ভরা খ্যাতির দই বানানোর কৌশল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে।  

কিন্তু কাজ করতে করতে মাত্রারিক্ত এই গরম অনেকটা কারিগরদের সহ্য হয়ে গেছে। লিটন ঘোষ, জীবন চন্দ্র, সুদেব ঘোষসহ কয়েকজন কারিগরের সঙ্গে কথা বলে অন্তত এমনটাই ধারণা পাওয়া গেছে।   
 
তবে খ্যাতির দই তৈরির কৌশল সম্পর্কে বলার আগে একটু সূচনাকালের দিকের কথা জেনে নেওয়া যাক।  
 
প্রবীণ ব্যক্তি কবি রহমতুল বারী ও আজিজুল হক বাংলানিউজকে জানান, দেশ ও দেশের বাইরে বগুড়ার তৈরি দইয়ের আজ যে সুনাম, সেই দইয়ের জন্মস্থান কিন্তু শেরপুর পৌরশহর। এই পৌরশহরে রয়েছে ঘোষপাড়া। মূলত বহুকাল আগে ঘোষ সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ গাভী পালন করতেন। সেই গাভীর দুধ থেকে দই তৈরি শুরু করেন। তবে প্রথমদিকে পাতলা দই তৈরি করা হত। তবে সময়ের ব্যবধানে দইয়ের চাহিদা বাড়তে থাকে। সে অনুযায়ী দই তৈরির ধরণও উন্নত হতে থাকে।
 
শুরুর দিকে যারা দই তৈরি করতেন বলে জানা যায় তাদের অন্যতম ছিলেন ঘোষপাড়ার বাসিন্দা গোপেশ্বরী ঘোষ। যদি তিনিও অনেক আগে পরলোকগম করেছেন। তবে তার ছেলে নিমাই ঘোষ বংশীয় পেশা আজও ধরে রেখেছেন।    
 
নিমাই ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, দই বানানোটা মূলত ঘোষপাড়া থেকেই শুরু হয়। ঘোষ সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রাগৈতিহাসিক যুগে দই তৈরি আরম্ভ করেন। তারমধ্যে তার বাবা ছিলেন অন্যতম। তবে ওই সময়টাতে পাতলা দই তৈরি হত। তবে সময়ের ব্যবধানে দই তৈরিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।  
 
তার ভাষ্য, ‘ঘোষ সম্প্রদায়ের দই বানানোর পদ্ধতি এখন অনেকের হাতে। কিন্তু এখনো শেরপুরের মতো শতভাগ মান সমৃদ্ধ দই অন্য কোথাও তৈরি হয় না। বরং এখানকার তৈরিকৃত দইয়ের মান দিন যাচ্ছে আরও বাড়ছে। জন্মস্থান শেরপুর হলেও দেশ ও বাইরে বগুড়ার দই হিসেবেই পরিচিত বৈকি। ’
 
এদিকে, ঐতিহ্যের ধারায় জেলার নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে ঘরোয়া পরিবেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় অনুষ্ঠানের খাবারের তালিকায় দই রাখা একটি সামাজিক অংশ হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে। এসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে দইয়ের উৎপাদন, বিপণন, চাহিদা ও জনপ্রিয়তা। সেই চাহিদা ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে দই বানানোর পদ্ধতিতে আনা হয়েছে বা হচ্ছে নিত্যনতুন পরিবর্তন।     
 
কারিগররা দই তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে বাংলানিউজকে জানান, প্রধান উপাদান দুধ। দুধ কড়াই বা ড্রামে নেওয়ার আগে ১০০ কেজি দুধের বিপরীতে ১০ কেজি পানি মেশানো হয়। তবে অবশ্যই তা ফুটন্ত হতে হবে। ফুটন্ত পানির ভেতর দুধ ঢালতে হয়। টানা আড়াই ঘণ্টার মত জ্বাল দিতে হয়। নাড়তে হয় বিরতিহীনভাবে। পুরো পানি জলীয় বাষ্প হয়ে উড়ে না যাওয়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলে।
 
এরপর চিনি দেওয়ার পালা। ওই পরিমাণ দুধের মধ্যে প্রায় ২০ কেজির মত চিনি দিতে হয়। জ্বাল দিতে হয় আরও প্রায় ১৫ মিনিটের মত। দুধের সঙ্গে চিনে মিশে যাওয়ার পরপরই সেই দুধ সরাসহ নানা ধরনের মাটির পাত্রে ভরা হয়। অবশ্য এর আগ মুহূর্তে মাটির পাত্রগুলো জ্বলন্ত চুলার ভেতর দিয়ে গরম করে নেওয়া হয়।      
 
দুধ ভরানো পাত্রগুলো জ্বলন্ত চুলার চারপাশে অনেকটা গোলাকার করে রাখা হয়। পাত্রগুলো ছাউনি বা ছাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এর আগে প্রয়োজন মতো ফুটন্ত দুধ কড়াই বা ড্রাম থেকে নেমে অন্য পাত্রে আলাদা করে রেখে দেওয়া হয়।
 
পাত্রে ভরানো দই সঠিকভাবে জমছে কী-না তা কিছুক্ষণ পরপর দেখতে হয়। পরে আলাদাভাবে অন্যপাত্রে নেমে রাখা ফুটন্ত দুধে সামান্য পরিমাণ বীজ দই (আগের দিন তৈরি দই) মিশিয়ে নিতে হয়। ছাউনি বা ছাতার নিচে প্রায় ঘণ্টাদুয়েকের মতো রাখার পর তা উঠিয়ে পরিমাণ মতো বীজ দই ঢালা হয় প্রত্যেক দই ভরানো পাত্রে।
 
বীজ দই দেওয়ার কাজ শেষ হলে আবারও দইয়ের পাত্রগুলো যথারীতি ছাউনি বা ছাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এভাবে রাখতে হয় টানা প্রায় ১২ ঘণ্টার মতো। সর্বশেষ ছাউনি বা ছাতা সরিয়ে ফেলা হয়। আর এসব প্রক্রিয়া অবলম্বনে তৈরি হয় গুণে-মানে স্বাদে ভরা খ্যাতির দই। পরে তৈরিকৃত এসব দই দেশ ও দেশের বাইরে বাজারজাত করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৯
এমবিএইচ/আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।