হাতে জাল নিয়ে মেয়ে ও ভাতিজাকে ঘাড়ের ওপর ওঠান চন্দন কুমার। এরপর নেমে পড়েন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের চন্ডিজান গ্রামের দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর অংশে।
নদীতে স্রোত না থাকলেও পানি একেবারে কম ছিল না। ফলে ঘাড়ের ওপর থাকা মেয়ে ও ভাতিজাকে নিয়ে নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য সাঁতার কাটেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। মাঝ নদীতে গিয়ে টালমাটাল হয়ে পড়েন চন্দন কুমার। সামলে উঠতে না পারায় ঘাড় থেকে পানিতে পড়ে যায় তার মেয়ে ও ভাতিজা।
মেয়ে কিরন বালাকে বাঁচাতে গিয়ে ভাতিজাও হাতছাড়া হয়ে যায় তার। নিজেকে, মেয়েকে ও ভাতিজাকে বাঁচাতে প্রাণপন চেষ্টা করতে থাকেন চন্দন কুমার। এভাবে কিছু সময়ের মধ্যে তিনজনই পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়ে যায়।
স্থানীয়রা বাংলানিউজকে জানান, বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) এমন হৃদয়বিদারক ঘটনাই ঘটেছে নদীর পাশে থাকা লোকজনের চোখের সামনে। দৃশ্যটা দেখার পরপরই চিৎকার শুরু করেন সেখানে থাকা লোকজন। চিৎকারে অনেকেই নদীতে নেমে পড়েন তাদের উদ্ধারে। আবার অনেকেই নৌকা নিয়ে আসেন। এদিকে স্থানীয় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকেও খবর দেওয়া হয়।
কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো সময় পেরিয়ে গেছে। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) বুলবুল ইসলামসহ অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা। পাশাপাশি একই সময় ঘটনাস্থলে পৌঁছান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও।
ঘটনাস্থলে পৌঁছেই স্থানীয়দের সহযোগিতায় তারা শুরু করেন উদ্ধার অভিযান। উদ্ধার করা হয় বাবা চন্দন কুমার ও মেয়ে কিরন বালার মরদেহ। বাবা ও মেয়ের মরদেহ তখনও মাছ ধরার সেই জালের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। জালের প্যাঁচে জড়িয়ে পড়ার কারণেই হয়তো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও নিজের, মেয়ের ও ভাতিজার প্রাণ রক্ষা করতে পারেননি চন্দন কুমার।
এদিকে বাবা-মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করা গেলেও ভাতিজা তখনও করতোয়ার পানিতে নিখোঁজ। ওইদিন রাত প্রায় ৮টা অবধি চেষ্টা করে তাকে উদ্ধারে ব্যর্থ হন ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল ও স্থানীয় লোকজন। পরে শুক্রবার (৩০ আগস্ট) সকালে নিখোঁজ অপূর্ব কুমার বুদাকে উদ্ধারে করতোয়ায় অভিযান শুরু করে ডুবুরিদল। পরবর্তীতে দুপুরে ছোট ফুলবাড়ীর বৈরাগী দহ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনার পর পুরো গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। স্বামী-সন্তানকে হারিয়ে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন স্ত্রী। স্বজনের চোখের পানিতে ভারী হয়ে ওঠেছে চারদিকের বাতাস।
চন্ডিজান গ্রামের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম ও তাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, চন্দন কুমার স্থানীয় একটি পার্কে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বৃহস্পতিবার ছিল তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ কারণে বাড়িতে বসে না থেকে জাল নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে যান। সঙ্গে তার মেয়ে ও ভাতিজাকেও নেন। নদী ঘেঁষা গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় চন্দন দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। কিন্তু ভালো সাঁতার জানার পরও নদীর পানিতে ডুবেই প্রাণ গেল তার। সঙ্গে মেয়ে ও ভাতিজাও বাঁচাতে পারেননি তিনি।
শেরপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) বুলবুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক তাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে নৌকা নিয়ে নদীতে তাদের খোঁজা হয়েছে। সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল তাদের জীবিত উদ্ধারে কোনো কমতি রাখেননি।
কিন্তু শেষ অবধি কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি। নদীর জলে ডুবে তিন জনেরই মৃত্যু হয়েছে। পরে নদী থেকে তিন জনের মরদেহ উদ্ধার করে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ধর্মীয় রীতি মেনে নিহতদের সৎকার করা হয়েছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১৯
এমবিএইচ/এসএ