সমগ্র বাংলার সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রাচীন এ দুর্গনগরী পর্যায়ক্রমে মাটি ও ইটের বেষ্টনী প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত যা উত্তর-দক্ষিণে ১৫২৫ মিটার দীর্ঘ এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৩৭০ মিটার প্রশস্ত ও চারপাশ সমতল ভূমি থেকে পাঁচ মিটার উঁচু। বেষ্টনী প্রাচীর ছাড়াও পূর্ব দিকে নদী ও অপর তিনদিকে গভীর পরিখা নগরীর অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত এবং পাল শাসক বর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাগণের রাজধানী ছিল। দুর্গের বাইরে উত্তর, পশ্চিম, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ৭/৮ কিলোমিটারের মধ্যে এখনও বিভিন্ন ধরনের বহু প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে। যা উপশহরের স্বাক্ষর বহন করে।
৬৩৯-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারতবর্ষ ভ্রমণকালে পুণ্ড্রবর্ধন পরিদর্শন করেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ হিউয়েন সাং বর্ণিত পুণ্ড্রনগর হিসেবে সঠিকভাবে শনাক্ত করেন।
১৯২৮-২৯ সালে মহাস্থানগড়ে সর্বপ্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু হয়। এ সময় নগরীর মধ্যে বৈরাগীর ভিটা, মুনীর ঘোন ও বাহিরে গোবিন্দ ভিটা নামক তিনটি স্থানে খনন করা হয়। দীর্ঘদিন পর ১৯৬০-৬১ সাল এবং পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে নিয়মিতভাবে দুর্গের বিভিন্ন অংশ খনন করা হয়। তবে ১৯৯৩ থেকে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সরকার যৌথভাবে মহাস্থানগড়ের খনন শুরু করায় এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা পায়। প্রথম পর্যায়ে ১৯৯৯ পর্যন্ত পূর্ব দুর্গ প্রচীরের মধ্যবর্তী এলাকায় খনন করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০০ সাল থেকে মাজারের পশ্চিম পাশে খনন কাজ করা হয়।
দীর্ঘ সময় ব্যাপী ব্যাপক অনুসন্ধান ও খননের ফলে দুর্গ নগরীর অভ্যন্তরে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে শুরু করে মুসলিম যুগ পর্যন্ত প্রায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে বসতি নিদর্শন উন্মোচিত হয়। ১৮টি স্তরে প্রাক মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও মুসলিম যুগের কাঁচা-পাকা ঘর বাড়ি, রাস্তা, নর্দমা, নালা, কূপ, মন্দির, মসজিদ, তোরণ, বুরুজ ইত্যাদি উন্মোচিত হয়েছে।
এছাড়াও আবিষ্কৃত হয়েছে তদানীন্তন নগর জীবনের বিভিন্ন অস্থাবর সাংস্কৃতিক দ্রব্যাদি। যেমন মৌর্য যুগের লিপিযুক্ত শিলাখণ্ড, ছাপাঙ্কিত রৌপা মুদ্রা ও ছাঁচে ঢালাই তাম্রমুদ্রা, ব্লাক অ্যান্ড রেড ওয়ার, রুলেটেড ওয়ার, উত্তরাঞ্চলীয় কালো সমৃদ্ধ মৃৎপাত্র, শুংগ, বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত পোড়ামাটির ফলক, প্রস্তর ও পোড়ামাটির মূর্তি, স্বল্প মূল্যবান প্রস্তর গুটিকা, পোড়ামাটির গুটিকা, গোলক, জালের কাঠি এবং মাটির ও ধাতব দ্রব্যাদি, প্রচুর সাধারণ মৃৎপাত্র এবং উৎকীর্ণ লিপিযুক্ত একটি প্রস্তর ফলক।
এ নগরী সংস্কারে প্রাচীনত্ব ধরে রাখতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুরনো ইট সংগ্রহ ও সেগুলো ধুয়ে-মুছে চকচকে করে চুন-সুড়কি দিয়ে সেগুলো স্ব-স্ব স্থানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পুরনো অবস্থা ধরে রাখতে উঁচু-নিচু স্থানগুলোকে মাথায় রেখে চালানো হয় সংস্কার কাজ। এবড়ো-থেবড়ো গাঁথুনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বসানো হয় ইটগুলো। ঐতিহাসিক এ স্থাপনার স্থাপত্য শৈলীকে ফুটিয়ে তুলতে অত্যন্ত নিপুণ হাতে সেগুলোকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
মহাস্থানগড়ে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় স্থাপনা। সুযোগ-সুবিধা বাড়াতেও বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।
দর্শনার্থী ও পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বগুড়া কাস্টোডিয়া রাজিয়া সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, এখানে সার্বক্ষণিক ২০ জন ব্যাটালিয়ন আনছার নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, দর্শনার্থী ও পর্যটকদের জন্য গড়া রেস্তোরা, স্যুভেনির কর্নার, শৌচাগার, চারকোনা ছাউনির ঘর, বেঞ্চ, ডরমেটরি, আনসার ক্যাম্প, গাড়ি পার্কিং চত্বর, পিকনিক স্পট, রাস্তা কার্পেনিংসহ নানা কাজ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৯
এনটি