গত নয় বছর ধরে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে ফেনী নদীর ৩৪ স্থানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প বসিয়ে পানি তোলা হচ্ছে ভারত থেকে।
এ বিষয়ে যৌথ নদী কমিশনসহ দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক বৈঠকে বাংলাদেশ আপত্তি জানানোর পরও ভারত তা অব্যাহত রেখেছে।
মানবিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ ফেনী নদীর পানি বিষয়ে সম্মত হলেও চুক্তি কার্যকরের আগে নদীতে স্থাপিত অবৈধ পাম্প অপসারণ ও চুক্তির বাইরে পানি উত্তোলন রোধে তদারকির দাবি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার ভগবান টিলা থেকে পাহাড়ি ছড়া হয়ে নেমে এসে নদীতে রূপ নেয় ফেনী নদী।
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রামগড়, চট্টগ্রামের মিরসরাই, ফেনীর ছাগলনাইয়া দিয়ে বয়ে গেছে এ নদী।
প্রায় ১৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গত ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম শহরের বাসিন্দাদের জন্য পানীয়জলের অভাব মেটাতে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি উত্তোলনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, ২০১০ সাল থেকে যখন ভারত পাম্প বসিয়ে পানি তুলে নেয় তখন শুষ্ক মৌসুমেই নদীর বিভিন্ন স্থানে বালুর চর জেগে ওঠে।
তারা জানান, নদীর দুই তীরে তখন চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ফেনী নদীর উপর নির্ভরশীল মুহুরি প্রজেক্টের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
মুহুরি প্রজেক্টের আওতায় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনীর ১৫টি উপজেলার প্রায় নয় লাখ একর কৃষি জমিতে লোনামুক্ত পানি সেচ কার্যক্রম চালানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে খাগড়াছড়ির রামগড়, মাটিরাঙ্গা ও নদীর তীরবর্তী সুফলভোগী বিভিন্ন উপজেলার জনসাধারণের মাঝে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ফেনী নদীর পানি প্রবাহের বার্ষিক গড় পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৮৭৮ কিউসেক। শুষ্ক মৌসুমে যেটি গিয়ে দাঁড়ায় ৭৯৪ কিউসেকে। ফলে ভারত যদি চুক্তি মোতাবেক এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি উত্তোলন করে তবে সেক্ষেত্রে ফেনী নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এদিকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে নো-ম্যানস ল্যান্ডের ১৫০ গজের ভেতরে পাম্প হাউস স্থাপন করে ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। একইভাবে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রামগড়, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ৩৪টি পয়েন্টে পাম্প মেশিন বসিয়ে পানি তুলছে বলে অভিযোগ ভারতের বিরুদ্ধে।
মহামুনি এলাকার ভুট্টাচাষি ওমর আলী বলেন, ফেনী নদী বাংলাদেশের নদী হওয়ার পরও ভারতের বিএসএফ সদস্যরা বাংলাদেশিদের নদীতে নামতে দেয় না। কিন্তু তারা বছরের পর বছর নদী থেকে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আগামী শীত মৌসুমে যখন নদীতে পানি থাকবে না তখন এ পারের কৃষকরা ধানসহ অন্য শীতকালীন শাক-সবজি চাষ করতে পারবেন না।
স্থানীয় সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন লাভলু বলেন, ভারত যদি ফেনী নদী থেকে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি উত্তোলন করে তবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে তেমন বিরূপ প্রভাব পড়বে না। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে নদীর ৩৪টি পয়েন্টে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প মেশিন বসিয়ে গড়ে ৩০-৪০ কিউসেক পানি তুলছে। যার প্রভাবে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকে বালুর চর জেগে ওঠে।
নাজিম উদ্দিন লাভলু বলেন, মানবিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী ভারতে যেমন পানি উত্তোলনে সম্মতি দিয়েছেন তেমনি করে অবৈধভাবে সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে স্থাপিত পাম্পগুলো অপসারণে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
রামগড় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারি বলেন, ভারত যেন অনুমোদিত চুক্তির বাইরে পানি তুলতে না পারে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নজর রাখতে হবে।
এর আগে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে রোববার (৬ অক্টোবর) পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ফেনী নদী থেকে ভারত যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হবে তার পরিমাণ ‘খুব সামান্য’।
প্রতিবেশী দেশের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম শহরের খাবার পানি সরবরাহের জন্য মানবিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী এতে সায় দিয়েছেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৯
এডি/এবি