পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মান্নানের আদালত মঙ্গলবার (৩ মার্চ) এক আদেশে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এর আগে গত ৩০ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা দায়ের করেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, জেলার নাজিরপুর থানার সামনে ও উপজেলা সদরের ভূমি অফিসের পেছনে ৬টি ভুয়া নামে ৩ শতাংশ সরকারি খাস জমি নিজের দখলে নেন আউয়াল। পরে সেখানে তিনি দ্বিতল পাকা ভবন তৈরি করে পল্লী বিদ্যুতকে অফিস হিসেবে ভাড়া দেন। এতে চুক্তি করেন এমপি পত্নী লায়লা পারভীন। এ জালিয়াতির ঘটনার অনুসন্ধানের পর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) (এসিল্যান্ড) দুদক কর্মকর্তাকে বলেছেন, তিনি ওই ৬ ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা ৬ ব্যক্তির অস্তিত্ব না থাকলেও সাবেক এমপি আউয়ালের স্ত্রী লায়লা পারভীনের নামে বাড়ির বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত সব ধরনের প্রমাণ পাওয়ার পর দুদক অনুসন্ধান শেষ করে ওই মামলা দায়ের করেছেন।
দুদকের ওই সূত্র আরো জানায়, সরকারি খাস জমি লিজ নিয়ে ওই জায়গায় স্ত্রী লায়লা পারভীনের নামে দ্বিতল পাকা ভবন করে তা পিরোজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে ভাড়া দিয়ে অবৈধভাবে দখলে রাখার অপরাধে দণ্ডবিধির ৪২০/৪০৯/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় একেএমএ আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন দুদক।
প্রায় একই প্রক্রিয়ায় জেলার নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী) উপজেলার ডাকবাংলোর কাছে একটি সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে দখল করে সেখানেও তিন তলার একটি ভবন নির্মাণ করেছেন। যা পরে আউয়াল ফাউন্ডেশন নামে নামকরণ করা হয়। এমপির ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি এ জালিয়াতির আশ্রয় নেন। ওই অপরাধে একেএমএ আউয়ালের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪২০/৪০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় আরো ১টি মামলা দায়ের করেছেন দুদক।
এছাড়া পিরোজপুর শহরের খুমুরিয়া মৌজার জেএল-৪৬, খতিয়ান নম্বর-২৯৩, রাজার পুকুর নামে পরিচিত ৪৪ শতক সরকারি খাস জমি চতুর্দিকে দেয়াল নির্মাণ করে দখলে নিয়ে নেন আউয়াল। এ অপরাধে আউয়ালের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪২০/৪০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় তৃতীয় মামলা দায়ের করেছেন দুদক। আর ওই সব মামলা দায়েরের আগে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাকে (আইয়াল) দেশ ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ১টি চিঠি দিয়েছিলেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, এ সব অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২০১৭ সালের জুন মাসে সে সময়ের সরকার দলীয় এমপি আউয়ালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি, সরকারি টাকা ও সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে দুদকে অভিযোগ দেওয়া হয়। পরে তা অনুসন্ধানে নামে দুদক টিম। এ সব অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৯ মে এমপি আউয়ালকে পরবর্তী সময়ে ২৩ মে’র মধ্যে দুদকের প্রধান কার্যালয় সেগুনবাগিচায় হাজির হয়ে সম্পদের বিবরণী দাখিলের জন্য নোটিশ পাঠানো হয়। কিন্তু এমপি আউয়াল ওই সময়ে দুদকে হাজিরা না দেওয়ায় দুদক ১৯ জুন আবারও তাকে নোটিশ দেয়। ওই নোটিশে তাকে ২৭ জুনের মধ্যে হাজির হয়ে সম্পদের বিবরণী দিতে বলা হয়। পরে তিনি হাজির হয়ে বক্তব্য দিলেও সে বক্তব্যে সন্তুষ্ট নন দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে (২০০৮- ২০১৮) পিরোজপুরের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ যে বিভাগে কাজ হয়েছে তাদের প্রতিটি থেকে ১০ শতাংশ হারে কমিশন নিয়েছেন আউয়াল। এমন কি সরকারিভাবে দুর্যোগ প্রবন এলাকা ইন্দুরকানি ও মঠবাড়িয়া উপজেলায় ৪টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণকালে তিনি নগদ ৮০ লাখ টাকা ও ২ হাজার ডলার উৎকোচ নেন বলে অভিযোগ পান দুদক।
দুদকের উপপরিচালক মো. আলী আকবর বাংলানিউজকে জানান, অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তারা (দুদক) নির্বাচন কমিশন, উপ-কর কমিশনারের কার্যালয় (পিরোজপুর), একাধিক ব্যাংকসহ ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
জানা গছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জামাল হায়দার প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু এরপরও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত এ আসনের সাবেক এমপি মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীকে পরাজিত করে প্রথম দফা এমপি হন। পরে আবারও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন। আর এ দু’বারে তিনি এমপি হয়ে এ সব দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তার বিরুদ্ধে দেওয়া বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে দুদক তার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ পেয়েছেন তা হলো- তার নিয়ন্ত্রণাধীন বুশরা এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স সুভাষ এন্টারপ্রাইজ নামের ২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা পিরোজপুরের ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এছাড়া তিনি কাজ পাওয়া অন্য সব ঠিকাদারের কাছ থেকে শতকরা ১০ ভাগ কমিশন নিয়েছেন। তার ২ আমলে পুলিশের নিয়োগ দেওয়া ৭৬৪ জনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আড়াইহাজার শিক্ষক ও ৩২৪ জন নৈশ প্রহরী নিয়োগে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের পদ বাণিজ্য। অবৈধ টাকায় ৪টি কার্গো জাহাজের মালিক হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরিতে বাণিজ্য করেছে, আর চাহিদা মতো টাকা না দিলে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের। জোর করে হিন্দুদের সহ অন্যদের প্রায় ডজন খানেক বাড়ি দখল ও লিখে নেওয়া। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নিজের পছন্দের বাইরের প্রার্থীদের বিরোধিতা করে অর্থের বিনিময়ে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন করা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২০
এসএইচ